চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করবেন জাতিসংঘের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা। এর মধ্যে দুই দিনের সফরে শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঢাকায় আসছেন মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপ। মহাসচিবের বিশেষ দূত হওয়ার পর এটি হবে বাংলাদেশে তার প্রথম সফর।
অন্যদিকে, সপ্তাহের শেষের দিকে তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি। চলমান রোহিঙ্গা সংকট, মিয়ানমার পরিস্থিতি, আগামী মার্চে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় রোহিঙ্গাদের জন্য যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা বা জেআরপি ঘোষণা এবং রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চলতি বছরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার এই সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
স্থানীয় কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, দুই দিনের সফরে আজ রাতে ঢাকায় আসছেন মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত জুলি বিশপ। সফরকালে তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। জুলি বিশপ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন। পরিদর্শনে ক্যাম্পে পরিচালিত জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি রোহিঙ্গা যুবক, নারী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করার কথা রয়েছে তার।
জানা গেছে, মহাসচিবের বিশেষ দূত জুলি বিশপ রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। পরদিন সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফরে যাবেন তিনি।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত বছরের এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ান সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপকে তার মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি সাবেক বিশেষ দূত নোয়েলিন হেইজারের স্থলাভিষিক্ত হন। নোয়েলিন দায়িত্বকালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।
ইউএনএইচসিআরের সফর নিয়ে স্থানীয় কূটনীতিকরা জানান, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরে থাকবেন। ইউএনএইচসিআরের শীর্ষ এই কর্মকর্তা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর পর বেশ কয়েক দফায় বাংলাদেশ সফর করেছেন। এবারের সফরে ফিলিপ্পো গ্রান্ডি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। কক্সবাজার ও ভাসানচরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে যাওয়ার কথা রয়েছে তার।
মহাসচিবের বিশেষ দূত এবং শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের সফর নিয়ে স্থানীয় কূটনীতিকরা বলছেন, জাতিসংঘের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার সফর রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। এক্ষেত্রে চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও তাদের প্রত্যাবাসন, মিয়ানমার পরিস্থিতি, রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে দাতাদের ভূমিকা; বিশেষ করে, আগামী মার্চে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় রোহিঙ্গাদের জন্য যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা বা জেআরপি ঘোষণা এবং রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চলতি বছরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনে জাতিসংঘের ভূমিকা এবং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট বৈঠকগুলোতে উঠে আসতে পারে।
সরকারের দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জাতিসংঘ বাংলাদেশের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা চলমান রেখেছে। গত ছয় মাসে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনসহ সংস্থাটির আরও কিছু কর্মকর্তা ঢাকা সফর করেছেন। আগামী মার্চে জাতিসংঘের মহাসচিবের সফর নিয়েও আলোচনা চলছে। ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় স্থাপন করা বিষয়ে বেশ জোরালো প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সংস্থাটি। তবে এ বিষয়ে আরও বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে চায় সরকার।
এই কূটনীতিক বলেন, মহাসচিবের বিশেষ দূত এবং শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের সফরকে সরকার স্বাগত জানায়। কেননা, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশের চাওয়া, মিয়ানমারে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই যেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়। আর এতে বিশ্ব সম্প্রদায়সহ জাতিসংঘের জোরালো ভূমিকা দেখতে চায় বাংলাদেশ। আগামী মার্চে সুইজারল্যান্ডে জেনেভায় রোহিঙ্গাদের জন্য জেআরপি ঘোষণা এবং রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চলতি বছরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনে জাতিসংঘ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ দূত এবং শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের সফরে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত সব বিষয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা-জেনেভার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আগামী মাসের মাঝামাঝিতে জেনেভায় বাংলাদেশ, ইউএনএইচসিআর ও এর অংশীদার মানবিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য নবমবারের মতো আন্তর্জাতিক সহায়তা তথা জেআরপি ঘোষণার বৈঠকে বসবে। এবার রোহিঙ্গাদের জন্য ৯৩২ মিলিয়ন ডলারের তহবিল চাওয়া হতে পারে। গত বছর (২০২৪) জেআরপির পরিমাণ ছিল ৮৫ কোটি ২৪ ডলার।
তবে গত কয়েক বছরের মতো এবারও ওই তহবিলের আওতায় অর্থ সংগ্রহ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে শঙ্কা করছেন মিয়ানমার নিয়ে কাজ করা এক কূটনীতিক। নাম না প্রকাশ শর্তে এই কূটনীতিক বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী দেশটির অর্থায়নে কাটছাঁট করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইডের অর্থায়নে বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন সব প্রকল্প ও কর্মসূচির ব্যয় অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইউএসএইডের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু সহায়তা পাওয়া যেত, এখন আর সেটি পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থায়ন করে আসছে সেটি চলমান আছে। গত বছর জেআরপির প্রায় শতকরা ৬৪ শতাংশ অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই ৫৪ শতাংশ সহায়তা দিয়েছে।
নদীবন্দর/এএস