এবারের ঈদুল ফিতরের আগে-পরে ১১ দিনে (২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল) দেশে ২৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৪৯ জন। প্রতিদিন গড়ে ২২ দশমিক ৬৩ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা শতাধিক।
সোমবার (৭ এপ্রিল) ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এবং নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংগঠনটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ঈদের ছুটির ১১ দিনে আহত হয়েছেন ৫৫৩ জন। কিন্তু বাস্তবে আহতের সংখ্যা ২ হাজারে বেশি।
সংগঠনটির প্রতিবেদনে ঈদযাত্রা ও দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে বলা হয়েছে, এই বছরে ১১ দিনের ঈদযাত্রায় প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ২২ দশমিক ৬৩ জন। ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরের আগে-পরে ১৪ দিনে ২৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৫ জন নিহত এবং ৪৫৪ জন আহত হয়েছিলেন। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিলেন ২০ দশমিক ৩৫ জন। আর ২০২৪ সালে ১৫ দিনে ৩৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৬৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি আহত হয়েছিলেন। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিলেন ২৪ দশমিক ৪৬ জন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঈদ উদ্যাপনকালে ব্যাপক হারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে। বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ১৩ জন পথচারী নিহত হয়েছেন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের মধ্যে ৫৭ শতাংশের বয়স ১৪–২০ বছর।
এ ছাড়া এবারের ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকা থেকে কমবেশি ১ কোটি ১৫ লাখ মানুষ ঘরমুখী যাত্রা করেছেন এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৪ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছেন। ঈদের আগে-পরে যথেষ্ট ছুটি থাকা, অনুকূল আবহাওয়া, বিভিন্ন সড়কের অবস্থা ভালো থাকা এবং সরকারের ব্যাপক তৎপরতার কারণে ঈদযাত্রা স্বস্তিকর ছিল। তবে সড়ক ও নৌপথে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে বলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে ভোরে ৩ দশমিক ১১ শতাংশ, সকালে ২৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ, দুপুরে ২১ শতাংশ, বিকেলে ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং রাতে ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে বিকেলে।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ৭৪টি দুর্ঘটনায় ৬২ জন নিহত। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ৭টি দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় সবচেয়ে বেশি ১৮টি দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকায় ৩১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত ও ৪৮ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা রোধে করণীয় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেশাগত সুযোগ-সুবিধার অভাবে, বিশেষ করে নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে যানবাহনের চালকেরা মানসিকভাবে অস্থির থাকেন। তাঁদের মধ্যে জীবনবোধ ঠিকমতো কাজ করে না। সব সময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। এই প্রেক্ষাপটে পরিবহন চালকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘ঈদ উদ্যাপনকালে মাত্র চার-পাঁচ দিনে বিপুলসংখ্যক মানুষকে পরিবহন করার মতো মানসম্পন্ন নিরাপদ গণপরিবহন আমাদের নেই। ফলে মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে গন্তব্যে যাত্রা করেন এবং দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। অবশ্য দায়িত্বহীনতা ও অসচেতনতার কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। আসলে একটি সুস্থ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে কমপক্ষে তিন বছরের একটি মধ্যমেয়াদি টেকসই সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, এই পরিকল্পনার অধীনে রেললাইন সংস্কার এবং সম্প্রসারণ করে ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে সড়কপথের মানুষকে ট্রেনমুখী করতে হবে। নদীপথ সংস্কার ও জনবান্ধব করতে হবে। সড়কে বিআরটিসির রুট বিস্তৃত করে বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সড়কের সব মেয়াদোত্তীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধ করতে হবে। ঈদযাত্রায় পোশাকশ্রমিকেরা যাতে পর্যায়ক্রমে ছুটি উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য পরিকল্পনা সাজাতে হবে। পোশাকশ্রমিকদের জন্য অঞ্চলভিত্তিক যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব উদ্যোগ ঠিকমতো বাস্তবায়ন করলে পরবর্তী সব ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হবে।’
নদীবন্দর/জেএস