বর্ষ বিদায় ও বরণকে ঘিরে উৎসবে মাতোয়ারা পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও চলছে বিভিন্ন আয়োজন। আনন্দ ও উল্লাসে অনুষ্ঠিত হলো বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু উদযাপন পরিষদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় নিজেদের ঐতিহ্য তুলে ধরার পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায় নিজেদের অধিকারের বিষয়েও ছিলেন সোচ্চার।
বুধবার সকাল থেকে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে পৌরচত্বরে সমাবেত হতে থাকেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। বেলুন উড়িয়ে ও বিজু নৃত্যের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা।
বর্ষ বিদায় ও বরণকে সামনে রেখে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষরা মেতেছে আনন্দ আর উৎসবে। লক্ষ্য সামাজিক এই উৎসবের মাধ্যমে তাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা। প্রতিবারের মতো এবারও উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। বাদ্যের তালে তালে নেচে-গেয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেন সবাই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা বর্ষকে বিদায় জানানোর এ অনুষ্ঠান তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচিত। এই উৎসব চাকমা জনগোষ্ঠী বিজু নামে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ বৈসুক, মারমা জনগোষ্ঠীর মানুষ সাংগ্রাই, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বিষু, কোনও কোনও জনগোষ্ঠী বিহু নামে পালন করে থাকে।
বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা বাহারি রঙের পোশাক তাদের সংস্কৃতি তুলে ধরেন। ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মাধ্যমেই সহজেই চেনা যাচ্ছে কে কোন সম্প্রদায়ের। বাংলা নতুন বছরের আগাম বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াই হলো তাদের উদ্দেশ্য। তবে আনন্দের এই আয়োজনে নিজেদের সংস্কৃতি ও অধিকার আদায়েও তারা ছিলেন সোচ্চার।
উৎসবে অংশ নেওয়া প্রথমা চাকমা বলেন, ‘প্রতি বছর এই বিজু র্যালিতে আমরা অংশগ্রহণ করি। যার মাধ্যমে পুরো বিশ্বের কাছে আমাদের কৃষ্টি-কালচার ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চাই। আমরা আমাদের পরিচয়ে বেঁচে থাকার অধিকার চাই।’
সীমা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘বাংলা বছরকে বিদায় ও বরণকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে উৎসবের রঙ লাগে। পুরনো বছরের সব দুঃখ দূর করে নতুন বছর যেন মঙ্গলময় হয় সেই জন্য প্রার্থনা।’
শোভাযাত্রা উপলক্ষে আলোচনায় সভায় উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার, চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা প্রমুখ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘আমাদের কৃষ্টি, প্রথা ও সংস্কৃতি আমরা ভুলে যেতে বসেছি। আমরা একদিন হারিয়ে যাবো। আমাদের যদি বৈসাবী বলা হয় বিজু, সাংগ্রাই ভুলে যাবো। আমাদের নৃ-গোষ্ঠী বলা হয় তাহলে চাকমা, মারমা, ত্রিপুারা ভুলে যাবো। ভুলে যাওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। আমাদের আমাদের আমাদের মতো থাকতে দিন। এই শুভ দিনে যাতে কোথাও কোনও গোলযোগ না হয়, সুন্দরভাবে আমরা আমাদের উৎসব পালন করতে চাই।’
চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায় বলেন, ‘বর্তমান সরকারের তিন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আমি মৌখিক ও লিখিতভাবে আমাদের পাহাড়ের কথাগুলো বলেছিলাম। তবে আমাদের কথাগুলো সেভাবে উঠে আসেনি কমিশনের প্রস্তাবে। এটি আমাদের হতাশ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় পুরো বাংলাদেশে বর্ষ বিদায় ও বরণকে উদযাপন করা হতো। এখন অনেকটা বদলে গেছে সংক্রান্তি উৎসবটি। একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারীরা এখনও এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।’
নদীবন্দর/এএস