জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত কমিশনের কার্যক্রম ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলোর একের পর এক নতুন শর্ত, ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবায়ন প্রস্তাব ও সাংবিধানিক অবস্থানের তারতম্যে এই কমিশন এখন কার্যত চাপে পড়েছে। দুই দফা সময় বাড়িয়েও এখনও চূড়ান্তভাবে চূড়ান্ত হয়নি বহু প্রতীক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। ফলে কমিশনের ভবিষ্যত কার্যক্রম এবং আসন্ন নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
কমিশন গঠিত হয় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, সাত সদস্যের একটি টিম নিয়ে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত এই কমিশন প্রথম থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ চালিয়ে এসেছে। কমিশনের দাবি অনুযায়ী, মোট ৮৪টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, যদিও এর মধ্যে বহু প্রস্তাবে রয়েছে ‘নোট অব ডিসেন্ট’—অর্থাৎ দ্বিমতসহ আংশিক সম্মতি।
সমস্যার সূচনাটা হয় বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে। সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে দলগুলোর অবস্থান একেবারেই ভিন্ন। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর মত, সংবিধান সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলো বর্তমান কমিশন বা অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে না—এটা করতে হবে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে। তাদের বক্তব্য, নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে কেবলমাত্র সংবিধান বহির্ভূত বিষয়গুলো কার্যকর হতে পারে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং আরও কয়েকটি দল চাইছে নির্বাচনের আগেই সনদের আইনি ভিত্তি তৈরি হোক এবং তা বাস্তবায়ন করা হোক। তাদের মতে, এই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন আয়োজন হলে সেটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় কমিশনের দ্বিতীয় দফার মেয়াদের শেষ বৈঠক। দীর্ঘ বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা অংশ নেন। অনেকেই কমিশনের মেয়াদ আবার বাড়ানোর দাবি তোলেন। সূত্র মতে, সরকার সেই দাবি বিবেচনা করছে এবং মেয়াদ আরও বাড়ানো হতে পারে।
বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন সংবিধান নির্ধারিত সময়ে—ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই হতে হবে। তিনি বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি বিষয় একে অপরের বিকল্প নয়। বিচার এবং সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া, কিন্তু নির্বাচনকে শর্তাধীন করা যাবে না। সাংবিধানিক ১৯টি বিষয়ের মধ্যে কিছু বিষয়ে তারা নোট অব ডিসেন্টসহ সম্মত হয়েছেন। তার মতে, এগুলোর বেশিরভাগই বাস্তবায়নযোগ্য এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে তা কোনো জটিলতা ছাড়াই কার্যকর করা সম্ভব।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ এই বৈঠকে জানান, নির্বাচনের আগে যদি সনদের ভিত্তিতে একটি প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার জারি করা যায় বা গণভোট আয়োজন করা হয়, তাহলে সেটির আইনি ভিত্তি তৈরি হবে এবং জনগণের সম্মতি পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রশাসনের হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ এসেছে, তাতে জাতীয় নির্বাচন নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই নির্বাচন যেন সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষ হয়, সেই নিশ্চয়তা দরকার।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর পরিবর্তন টেকসই করতে হলে একটি নতুন গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমেই তা হওয়া উচিত। তার মতে, এত বড় কাঠামোগত পরিবর্তনকে কেবল সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা কঠিন। কারণ, দেশে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সংবিধান সংশোধনী হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ হয়ে বাতিল হয়েছে। সেজন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছে টেকসই পদ্ধতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই সনদের বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। তার মতে, এই রাজনৈতিক ঐকমত্য থেকেই জাতির নবজন্ম হবে। তিনি বলেন, জাতি আমাদের হাতে আলাদিনের চেরাগ তুলে দিয়েছে। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা তার কাছে ছোট কোনো কিছু চাইবো, না একটি নতুন বাংলাদেশ চাইবো। তার ভাষায়, আমরা হাইওয়ে বানিয়ে ফেলেছি, এখন আর কোনো বিকল্প রাস্তা নেই।
তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তারা এতদূর এসে যদি শেষ ধাপে এসে থেমে যায়, তাহলে সেটি হবে ইতিহাসের জন্য এক চরম ব্যর্থতা। তিনি বলেন, যে সুযোগ আজ আমাদের হাতে এসেছে, তা যুগে যুগে আসে না। স্বৈরাচার আসার সব পথ বন্ধ করতে হলে আমাদের সবাইকে এক হতে হবে। দ্বিমতের কোনো সুযোগ এখানে নেই।
ড. ইউনূস আরও জানান, নির্বাচন হবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই, এবং সেটি হবে একটি মহোৎসবের রূপে। তবে সেজন্য প্রয়োজন হবে নির্ভুল ও প্রশ্নাতীত একটি জাতীয় দলিল—যে দলিলকে ঘিরেই সব রাজনৈতিক পক্ষ একমত হবে।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার, এবং বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা।
নদীবন্দর/জেএস