জনপ্রিয় হওয়ার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা করেছিলেন শোবিজে। ছিল অপার সম্ভাবনা। ১৯৯৯ সালে তিন্নি র্যাম্প মডেলিং দিয়ে তার যাত্রা। প্রথম টিভি বিজ্ঞাপন হেনোলাক্স ক্রিম দিয়ে পরিচিতি পান। পরে কাজ করেছেন স্টারশিপ কনডেন্সড মিল্ক, লিজান মেহেদী, গন্ধরাজ তেল, এলিট পেইন্ট, কোয়ালিটি আইসক্রিম, বম্বে উপটান ও রিচি জুসের বিজ্ঞাপনে।
অল্প সময়ই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার মায়াবী হাসির ছবি সম্বলিত বাহারি বিলবোর্ডে ছেয়ে গিয়েছিল বড় শহরগুলো। টিভি খুললেই দেখা মিলতো তার। হয়ে উঠেছিলেন সময়ের চাহিদাসম্পন্ন একজন মডেল।
জনপ্রিয়তার হাত ধরে কাজ শুরু করেছিলেন টিভি নাটকেও। পরিচালক বাদল খন্দকারের একটি চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। সেটি আর করা হয়নি।
ক্যারিয়ারের মধ্য গগনে থাকা অবস্থায় ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদীর ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশে পাওয়া গেল এই মডেলের মরদেহ! শরীরের বিভিন্ন অংশে থেঁতলানো জখম। মাথার খুলিতে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত। চেনাই যায়নি এই নিথর দেহটি শোবিজের মোস্ট গ্ল্যামারাস মডেল ও অভিনেত্রীর।
মনে পড়ে মডেল তিন্নির কথা? যিনি মডেল তিন্নি নামেই সবার কাছে পরিচিত। যিনি রঙিন স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু করে করুণ পরিণতির শিকার হয়ে অকালে প্রাণ হারালেন। তার মৃত্যু সারাদেশে চাঞ্চল্যের শুরু করেছিল। দেশের আলোচিত কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের একটি মডেল তিন্নি হত্যা।
কে ছিলেন তিন্নি?
তিন্নির পারিবারিক নাম সৈয়দা তানিয়া মাহবুব। তিন্নিরা ছিলেন দুই বোন। ছোট বোন এয়ার হোস্টেস। তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কর্মজীবন প্রবাসে কাটালেও এখন দেশে একা থাকেন। তিন্নির মা স্বামীকে ছেড়ে পাকিস্তান চলে গেছেন।
মৃত্যুর সময় ছিলেন বিবাহিত। দেড় বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তানও ছিল তার।
জানা গেছে, তিন্নির একমাত্র মেয়ে এখন বাবার সঙ্গে বিদেশে থাকেন।
করুণ পরিণতি
দীর্ঘদিন ধরে চলমান মামলার নানা তথ্য ও প্রচার হওয়া নানা সূত্রে জানা যায়, অবৈধ প্রেমই তিন্নির জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে এনেছিল। মডেল তিন্নির সঙ্গে কাজের সূত্র ধরেই সাবেক ছাত্রনেতা ও জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভির পরিচয় হয়। তাদের এক পর্যায়ে সখ্য গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্কও তৈরি হয়।
তারা দেশ-বিদেশে একত্রে ঘুরে বেড়ান। তিন্নি ছিলেন বিবাহিত। অভির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিন্নির সঙ্গে স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
২০০২ সালের ৬ নভেম্বর অভি নিজে তিন্নি ও তার স্বামী পিয়ালের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটান। এমনকি তিন্নির দেড় বছরের শিশুকন্যাকে পিয়ালের হেফাজতে দিয়ে পিয়ালকে বাসা থেকে বের করে দেন অভি। অভি ওই বাসায়ই অবস্থান নেন।
সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অভি গোপনে তিন্নির সঙ্গে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক নিয়েই আগ্রহী ছিলেন। তিন্নিকে বিয়ে করে সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না। তা নিয়েই বাধে দ্বন্দ্ব।
তিন্নি বিয়ে করতে অভির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। এদিকে পিয়ালের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি ও তিন্নির সঙ্গে অভির সম্পর্কের বিষয়টি মিডিয়ায় প্রচার হতে থাকে। ঠিক ওই মুহূর্তে অভি খুন করার পরিকল্পনা করেন তিন্নিকে।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অভি ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর তিন্নিকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করেন। লাশ গুম করার জন্য গাড়িতে করে নিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে রাখেন। লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ চিনতে পারেনি এটা মডেল তিন্নি। পত্রিকায় ছবি ছাপা হলে তিন্নির আত্মীয়স্বজন শনাক্ত করেন মরদেহটি তিন্নির। তার আগেই ময়নাতদন্ত শেষে দাবিদার না থাকায় বেওয়ারিশ হিসেবে লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কর্তৃক জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানা-পুলিশ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক ছাত্রনেতা ও জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি অভি কানাডায় পলাতক রয়েছেন। ২০১০ সালের ১৪ জুলাই আসামি অভির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত। হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় আইন অনুযায়ী অভির পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে শাহ ইলিয়াস রতন নামের এক আইনজীবী নিযুক্ত করেন আদালত।
সেই মামলা এখনো চলমান।
নদী বন্দর / সিএফ