জাতীয় রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আসছে জুলাইয়ের মধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সনদ (চার্টার) ঘোষণার জন্য কাজ করছে এই কমিশন। কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে দেশের ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রাথমিক দফার আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে, এবং সামনে রয়েছে দ্বিতীয় দফার বিষয়ভিত্তিক সংলাপ।
কমিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, দ্বিতীয় দফার আলোচনা শেষ করে দলগুলোর একমত ও দ্বিমত বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করা হবে। এরপর একটি ঐক্যমতের খসড়া তৈরি করে তা জাতীয় সনদ আকারে চূড়ান্ত করা হবে, যা জুলাই মাসেই প্রকাশের লক্ষ্য রয়েছে। যদিও কমিশনের মেয়াদ ১৫ আগস্ট পর্যন্ত, তবুও তার আগেই কাজ সম্পন্ন করতে আগ্রহী সংশ্লিষ্টরা।
এনসিসি গঠন নিয়ে ভিন্নমত
জাতীয় সনদের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। তবে এ বিষয়টিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। বিএনপি এই কাঠামোকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য মনে করছে না। দলটির মতে, এনসিসি একটি নতুন ধারণা, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যে আগে কখনো প্রয়োগ হয়নি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী কাঠামোটির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও এনসিসির কার্যকারিতা ও গঠনতন্ত্রে ‘মূলগত সংস্কার’ চায়। অপরদিকে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এনসিসি গঠনকে সমর্থন দিয়েছে, যারা মনে করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় এবং সংসদীয় ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিতে এনসিসি অপরিহার্য।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, এনসিসি নিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ মতামত পাওয়া গেছে। উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে বেশিরভাগ দল একমত হলেও, এর কাঠামো ও কার্যপ্রণালী কেমন হবে—সে বিষয়ে ভিন্নতা রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে একটি ‘ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা’র জায়গায় পৌঁছানোই এখন মূল লক্ষ্য বলে জানান তিনি।
দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা হবে ইস্যুভিত্তিক
কমিশনের পরবর্তী ধাপে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ইস্যুভিত্তিক আলোচনা করা হবে। এক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে যেখানে পূর্ণ, আংশিক কিংবা দ্বিমত রয়েছে, তা তালিকাভুক্ত করে নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব বলে মনে করছে কমিশন।
এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমরা এখন একমত, দ্বিমত ও আংশিক মতের জায়গাগুলো চিহ্নিত করছি। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শেষে একটি চূড়ান্ত জাতীয় সনদ দাঁড় করানোর চেষ্টা থাকবে। জুলাইয়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চাই, তবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার ওপর।”
ড. ইফতেখারুজ্জামান, যিনি দুদক সংস্কার কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি জানান, আলোচনা অনেক আগেই শেষ হওয়ার কথা ছিল, তবে কয়েকটি দলের অনুরোধে তা কিছুটা পিছিয়েছে। তিনি আশাবাদী, দ্বিতীয় দফার আলোচনায় অধিকাংশ ইস্যুতে ঐকমত্য সৃষ্টি হবে।
রাজনৈতিক সংকটে আলোচনাই আশার আলো
বিগত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সহিংসতা এবং দোষারোপের রাজনীতির কারণে দেশে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ ব্যাহত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগ রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সংলাপের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনমুখী রূপরেখা তৈরি করে, কমিশন দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে চায়।
জুলাই মাসেই জাতীয় সনদ ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের পথ সুগম হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কমিশনের সদস্যরা একথাও স্বীকার করছেন, এটি একটি কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া। তবুও তারা আশাবাদী যে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা থাকলে এই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।
নদীবন্দর/ইপিটি