সুরভী আক্তার। ঠাকুরগাঁও সদরের মুন্সিরহাটে বাবার বাড়ি। তিন বোনের এক ভাই নবম শ্রেণিতে পড়ে। বড় বোন প্রতিবন্ধী, দ্বিতীয় বোনের বিয়ে হয়েছে, তৃতীয় সুরভী। তারও বিয়ে হয়েছে। বাবা সাইকেল মিস্ত্রি রফিকুল বাচ্চুর দুটি সংসার। তিন বোনের জন্মের পর বাবা দ্বিতীয় সংসার গড়েন। সেই মায়ের এক ছেলে এক মেয়ে। ভাইটি যখন মায়ের পেটে; তখন ২০০৩ সালে স্ট্রোক করে বাবার মৃত্যু হয়।
বাবার আবাদী কোনো জমি ছিল না। ছোট মা চলে যান ঢাকায় তার সন্তানদের নিয়ে। সুরভীর মাও ঢাকায় অন্যের বাড়িতে কাজ করে এখন আধাপাকা বাড়ি করেছেন। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মায়ের মত সুরভীও ঠাকুরগাঁও চলে যান অন্যের সংসারে গৃহপরিচালিকা হিসেবে। সেখানে পাঁচ বছর থাকার পর আরও সাত বছর একই রকম করে ঢাকায় আরেকটি পরিবারে সহযোগিতা করেন সুরভী। পেটেভাতে থাকতেন সেখানে।
মালিকের আর্থিক সহযোগিতায় তার বিয়ে হয় ২০১২ সালে। তখন বয়স ষোলো কি সতেরো। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের সমশেরনগর গ্রামের তুহিন ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় সুরভীকে ৪০ হাজার টাকা এবং ১৩ হাজার টাকার স্বর্ণ দেওয়া হয়। এ দিয়েই ৭ বছরের হিসেব মিটিয়েছেন তারা।
কৃষক পরিবারের সন্তান তুহিন ইসলাম ছয় ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ। সুরভী বলেন, ‘বিয়ের পর এসে একবেলা খাইতাম, একবেলা খাইতাম না।’ ৪০ হাজার টাকা থেকে সুরভী ৭টি ছাগল, ২টি মুরগি, ৪টি হাঁস কেনেন। একবছর পর ৫টি ছাগলের বাচ্চা বিক্রি করে একটি গরু কেনেন। বছরে ৮ হাজার টাকায় দেড় বিঘা জমি বর্গা নিয়ে পরিশ্রম করেন দু’জনে মিলে।
ফসলের টাকা ও গরু-ছাগল বিক্রির টাকা দিয়ে ১ লাখ টাকায় নিজেদের এক বিঘা জমির বন্ধকী ছুটিয়ে নেন। আগে ছাপড়া ঘর ছিল। পরে পিলার দিয়ে টিনের ঘর দেন। বাবার থেকে পাওয়া ২ বিঘা জমির এক বিঘায় আবাদ করলেও এ এক বিঘা ছোটাতে বেশ সময় লেগেছে তুহিনের। বাড়ির ভিটায় আট শতক জমি। শহরে থাকা সুরভী হাতে তুলে নেয় কোদাল, নিড়ানি দেয় ডাউকি দিয়ে। সুরভীর বের হয়ে যাওয়া দেখে সকাল সকাল স্বামীও পেছনে ছোটেন তার। স্থানীয়রাও তার সাথে পাল্লা দিয়ে পারেন না।
নিজের জমিতে ধানের চারা লাগানো, ধান কাটা, বাঁধা, মাড়াই করা সব কাজেই এখন সিদ্ধহস্ত তিনি। ধান ছাড়াও কচু, ঢেঁড়শ, পাট শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক, বরবটি, বেগুন, সিম এবং পেঁপেসহ মৌসুম ভিত্তিক শাক-সবজি বিক্রি করে চলে সংসার। কীটনাশক ছাড়াই এসব জৈবপদ্ধতিতে চাষ করেন। সুপারি, বাদাম, নারকেল, লিচু, আম, জলপাই, বড়ই, লেবু এবং পেয়ারাও আছে বাড়ির চারদিকে। সেগুলো থেকেও আয় হয়।
এখন সুরভীর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ফারিহা আক্তার তাছিন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে নীহা আক্তারের বয়স চার বছর। বাড়িতে হাঁস ১১টি, মুরগি ১০টি, গরু ৩টি, ছাগল ২টি। এর আগে ২টি ছাগলের বাচ্চা শেয়ালে নিয়ে গেছে ঈদের দিন। কুকুরের কামড়ে মরেছে তিনটি বাচ্চা। শেয়াল-কুকুরের উৎপাত সত্ত্বেও চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।
মা কুলসুম বেগমই সুরভীর অনুপ্রেরণা। সুরভী বলেন, ‘এ এগিয়ে চলায় সাহস দিয়েছে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড। আড়াই বছর ধরে তাদের উঠান বৈঠকে যাওয়ার ফলে আমার অন্যরকম পরিবর্তন এসেছে। সেখানে বাড়ির উঠোনে পুষ্টিকর সবজি চাষ, পরিবারের যত্ন নেওয়া, পরিষ্কার থাকা, সঠিক নিয়মে রান্না করা, গবাদি পশু-পাখি পালন ও আয় থেকে সঞ্চয় করা শিখতে পেরেছি। কিছু প্রশিক্ষণও নিয়েছি। ছোটখাটো অসুখ হলে কী খেলে সুস্থ হবো, সেসব জেনেছি। হাঁস-মুরগির ডিম, গরুর দুধ, এমনকি মাছটাও কিনতে হয় না। স্বামীর বড় ভাইয়ের ছোট্ট পুকুরে ভাগে মাছ চাষ করি।’
সুরভীর স্বামী বলছিলেন, ‘তেল, লবণ, হলুদ ছাড়া কিছু কিনতে হয় না। হাটে যাওয়ার সময় সুরভী বিভিন্ন সবজির বীজ আনতে বলে। তাছাড়া জৈবপদ্ধতিতে উৎপাদন করায় বিষমুক্ত টাটকা নিরাপদ সবজি খাই আমরা।’
পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় নিজের ভাগ্য বদলে ফেলার জন্য জাপানভিত্তিক সংস্থা ‘হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ থেকে সুরভী আক্তার অর্জন করেছেন ‘হাঙ্গার ফ্রি প্রাইজ ২০১৯’। পুরস্কারের টাকা দিয়ে ছাগল কিনেছেন, বাড়ির একদিকে টিনের বেড়া দিয়েছেন। এখন অন্য গ্রামের নারীরা তার সফলতার গল্প শুনতে আসে।
নদী বন্দর / জিকে