আগের দিনে বাংলার জমিদার ও বিত্তশালীদের নৌ-ভ্রমণে শখের বাহন ছিল বজরা। এতে খাবার-দাবার, ঘুমানোসহ থাকতো সব সুবিধা। কোনোটাতে লাগানো হতো পালও। আর মাঝি থাকতো একাধিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন লেখায় আমরা এই বজরার বর্ণনা পাই। ভারতের কাশ্মীর কিংবা কেরালাও বজরা বা হাউজবোটের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু নদীমাতৃক দেশ হওয়ার পরও এদিক দিয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।
লেক বা নদীতে ভেসে শুধু হাউজবোটে রাত কাটাতেও অনেকে কেরালা ও কাশ্মীর ভ্রমণ করেন। অথচ আমাদের অসংখ্য নদী, হাওর থাকতেও এ সুযোগ লুফে নিতে পারিনি। সময় বদলেছে। প্রাচীনতায়ও এখন অনেকে খোঁজেন আধুনিকতা। অনেকে স্বাদ নিতে চান অতীতের। আর নতুন প্রজন্মের কাছে তো সবই নতুন।
সম্প্রতি সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে বজরা কনসেপ্ট ফের ফিরিয়ে আনা হয়েছে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে। অল্প কদিনে নজর কেড়েছে ভ্রমণবিলাসীদের। টাঙ্গুয়ার হাওর, নিলাদ্রী লেক, টেকেরঘাট, বারেকাটিলা, শিমুল বাগান ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে এখন অন্যতম আকর্ষণ নতুন আঙ্গিকে তৈরি হওয়া বজরা।
এই বজরা সবচেয়ে কম সময়ে, মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ থেকে পর্যটকদের নিয়ে যায় স্বপ্নের মতো সুন্দর টাঙ্গুয়ার হাওরে। এই সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো অন্য কোনো নৌযান দিয়ে সম্ভব নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইঞ্জিনচালিত এ বজরা নৌকাটি গত জুলাই মাসে পর্যটকদের সুবিধার জন্য তাহিরপুর থেকে না ছেড়ে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের মল্লিকপুর এলাকার বৈটাখালী ঘাট থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে ঘুরতে আসা পর্যটকরা গাড়ি থেকে আব্দুজ জহুর সেতুর নিচে নেমেই বিনা খরচে মাত্র এক মিনিট হেঁটে বজরায় উঠতে পারেন। তবে বজরায় হাওর-বিলাস করতে চাইলে আগেই অনলাইনে বুকিং দিতে হবে।
যা আছে বিলাসবহুল বজরায়
সাধারণ ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে যেসব সুবিধা আমরা দেখতে অভ্যস্ত, তারচেয়ে বেশিকিছু আছে এই বজরায়। এতে কেবিন মোট ছয়টি। যাতে আধুনিক বিছানা, ফ্যান, লাইট ও মোবাইল চার্জ করার ব্যবস্থা আছে। ওয়াশরুম দুটি। একটিতে হাই কমোড ও একটি সাধারণ কমোড। আছে জরুরি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া ও ওয়াটার ফ্লোটিং বেড।
পর্যটকদের সার্বক্ষণিক সুবিধা-অসুবিধা দেখভালের জন্য একজন ম্যানেজারসহ সাতজন আলাদা আলাদা সেক্টরে কাজ করেন। রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থাও বজরার মধ্যে।
বজরার দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজার মো. আসাদ মিয়া বলেন, মূলত সুনামগঞ্জ থেকে আমরা বজরার কোনো বুকিং নেই না। এতে ঘুরতে হলে আগে থেকে অনলাইনের মাধ্যমে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়।
বজরায় থাকা বাজার শাখার ম্যানেজার হুমায়ূন আহমেদ বলেন, আমার কাজ পর্যটকদের পছন্দমতো বাজার করে দেওয়া। কারণ ঘুরতে গেলে অনেকের অনেক পছন্দের খাবার থাকে, সেগুলো আমি বাজার থেকে কিনে এনে বার্বুচির কাছে দিলে সেগুলো তারা রান্না করে পর্যটকদের সামনে উপস্থাপন করেন।
নৌকায় থাকা বাবুর্চি জমির ও জিয়াউর রহমান বলেন, আমরা দুজন বাবুর্চি তিনবেলা পর্যটকদের পছন্দের খাবার তৈরি করে দেই। খেয়ে সবাই খুব প্রশংসা করেন। কেউ কেউ এমন স্বাদের খাবার কখনও খাননি বলেও জানান।
মাঝি আব্দুস সালাম বলেন, আমরা মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের নিয়ে যাই, যা আর কোনো নৌকায় সম্ভব নয়।
বজরায় খাবারের মেন্যু
সকালে খাবারে রোস্ট, খিচুড়ির সঙ্গে ভুনা ডিম, দুপুরে আলুভর্তা, সবজি, ডাল, রুই মাছ, রাজহাঁসের মাংস, সন্ধ্যার নাস্তা নুডুস, বিস্কুট ও রং চা। রাতের খাবারে থাকে মুরগির মাংস, মাছভর্তা, আলুভর্তা ও ডাল। এর বাইরে পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ীও খাবার তৈরি করা হয়।
বজরায় ঘুরতে আসা পর্যটক রিয়া আক্তার বলেন, এতদিন শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, আজ নিজে এসেছি। নৌকার ভিতরটা বাসার মতো। এত সুন্দর বিলাসবহুল নৌকা আগে দেখেনি। তবে সত্যি খুব ভালো লাগছে এত সুন্দর জায়গা দেখতে এত সুন্দর বাহনে যাচ্ছি।
নদী বন্দর / পিকে