ঢালিউডে যখন নানা দ্বন্দ্ব আর সংকটে টালমাটাল অবস্থা সেই ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়া। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় প্রতিষ্ঠানটির প্রথম সিনেমা ‘আমি নেতা হবো’। এই যাত্রা শাপলা শুরু করেছিল চিত্রনায়ক শাকিব খানকে নিয়ে। নায়িকা ছিলেন বিদ্যা সিনহা মিম।
নানা কারণে শাকিব খান ছিলেন তখন সমালোচনার তুঙ্গে। তাকে বয়কট করা হয়েছিল ১৭ সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত চলচ্চিত্র পরিবারের পক্ষ থেকে। এমনি অসময়ে শাকিবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন শাপলা মিডিয়ার কর্ণধার সেলিম খান।
সেই সম্পর্ক এখন আর বন্ধুত্বের আসমানে উড়ছে না। বরং নানা কারণেই একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন দুই খান। তারা সুযোগ পেলেই একে অন্যকে ইশারায় বা প্রকাশ্যে সমালোচনায় ভাসান। সেলিম খান যখন একসঙ্গে ১০০ সিনেমার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেসময় সেই উদ্যোগকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন শাকিব খান। বলেছিলেন, অল্প বাজেটে মানহীন ১০০ সিনেমার দরকার নেই। ভালো বাজেটের একটি সিনেমাই ইন্ডাস্ট্রির জন্য যথেষ্ট।
সেই কটাক্ষের জবাব দিতে গিয়ে সেলিম খান শাকিবের নাম নিয়েই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। সাংবাদিকদের মাধ্যমে তিনি শাকিবের কাছে জানতে চান, ‘এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের সুপারস্টার শাকিব খান বলেছিলেন, ১০০ সিনেমা বানানোর দরকার নেই। ভালো সিনেমা একটাই যথেষ্ট। ভদ্রলোকের কাছে আমার প্রশ্ন উনি তো ভালো সিনেমা করেন। কিন্তু বর্তমানে যে সিনেমাটির শুটিং তিনি করছেন টাঙ্গাইল না পূবাইলে মাত্র ৬০ লাখ টাকা বাজেটে। উনি যদি সুপারস্টারই হন তাহলে ৬০ লাখ টাকা বাজেটের সিনেমা উনি কেন করছেন? উনি তো সুপারস্টার, সরকারি অনুদানের সিনেমা করছেন কেন? তাহলে উনি কিসের সুপারস্টার?’
পূজন মজুমদারের পরিচালনায় ‘প্রিয়া রে’ সিনেমার শুটিং চলছে চাঁদপুরে। শুটিং স্পটে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই কথা বলেন সেলিম খান।
শাকিবকে বেশকিছু অভিযোগে অভিযুক্ত করে তিনি বলেন, ‘উনি চাচ্ছেন যে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যাক। বঙ্গবন্ধু মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি দিয়ে গেছিলেন। সেই ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক, আর্টিস্ট, টেকনিশিয়ান সবাই এখানে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে ৫টি ছবির সেন্সর হয়েছে। ২২টা সিনেমা একসাথে শুরু করেছি। অন্যগুলোও চলছে। সবাই মিলে একসাথে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিদিনই আমাদের ৫-৬টা সিনেমার কাজ চলছে।
উনি বলেন একটা সিনেমাই যথেষ্ট। উনি একাই কাজ করবেন। উনার পছন্দের লোকরা, টিম কাজ করবে। বাকি সবাই না খাইয়া থাক। উনি বেঁচে থাকুক, উনার টিম বেঁচে থাকুক। সবাই না খাইয়া মারা যাক। এটাই উনার মনোভাব।
উনি বলেন একটা ভালো সিনেমাই যথেষ্ট। উনি সুপারস্টার। অথচ সরকারি অনুদানের সিনেমা করছেন। কখন একজন সুপারস্টার সরকারি অনুদানের সিনেমা করতে যায়? যখন কাজ নাই, বেকার, ঘরে বসে থাকেন তখন।’
আপনি তো শাকিব খানকে নিয়ে কিছু সিনেমা প্রযোজনা করেছেন। সেগুলোর রেজাল্ট কি? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম খান বলেন, ‘দেখেন তিনি যদি সুপারস্টারই হতেন আর তার একটি সিনেমাই যথেষ্ট হতো তাহলে তাকে নিয়ে তো আমি ব্যাক টু ব্যাক সিনেমা করতাম। করছি না তো।
কারণ শাকিব খানকে নিয়ে সিনেমা বানানোর মানেই হলো পরিচালক সাহেব কল টাইম দেবেন ৮টায়, উনি সেটে আসবেন ২টায়। এখন উনার বিবেক রাখা দরকার যে আমি একজন হিরো আমার অনেক কো-আর্টিস্ট আছে। সবাই তার জন্য বসে থাকবে। তার দেরি করে আসায় অন্য আর্টিস্টরা কষ্ট পাচ্ছে, টেকনিশিয়ানরা কষ্ট পাচ্ছে, পরিচালক কষ্ট পাচ্ছে। খরচটাও বাড়ছে। এই তো শাকিব খান। এইটা কি সুপারস্টারগিরি?
তবু যদি সিনেমা চলতো মানা যেত। বাস্তবতা তো কেউ বলে না। এই সুপারস্টার নিয়ে সিনেমায় লস। কলকাতায় উনার সিনেমার স্যাটেলাইট ভ্যালু নাই। ২০ লাখের বেশি নাই। এখন তো নেয়ই না। এখন যদি আমি বাংলাদেশের নতুন কোনো আর্টিস্ট নিয়ে কলকাতার কোনো আর্টিস্টের সঙ্গে সিনেমা করি তাহলে স্যাটেলাইট ভ্যালু পাই এক কোটি টাকা। আর যখনই সেখানে শাকিব খান আছে, নেবে না। আবার দেখেন সিনেপ্লেক্সে, শাকিব খান থাকলে কোনো ছাত্রছাত্রী সিনেমা দেখতে হলে যায় না।
অথচ আমাদের ‘চোখ’ রিলিজ দিয়েছি। প্রত্যেকটা সিনেপ্লেক্স নিয়েছে। কিন্তু শাকিব খান থাকলে সিনেপ্লেক্স নেয় না। আমার ঘরেই পাঁচটা সিনেমা ছিল, সিনেপ্লেক্স নেয় নাই।’
কিন্তু শাকিব খানের সঙ্গে কোনো সিনেমাই করে কি ব্যবসায়িক সাফল্য পাননি? এই প্রশ্নের জবাবে সেলিম খান বলেন, ‘শাকিব খানের সঙ্গে সিনেমা করে পেয়েছি উনি দেরি করে আসে। বারবার কষ্ট দেয়। তিনি তো বলেন একটি সিনেমাই যথেষ্ট। যদি তাই হতো তাহলে একটা কথা বলি, শাকিব খানকে নিয়ে আমরা একটা সিনেমা নির্মাণ করেছি। নামটা হলো ‘বিদ্রোহী’। ভয়ে রিলিজ দিতে পারছি না। বিগ বাজেটের ছবি। ভালো ছবি। কিন্তু এটা রিলিজ করলে ৫০-৬০ লাখ টাকাও ঘরে ফিরবে কি না আমি সন্দিহান। মুখে আছেন শাকিব খান কামে নাই।’
এসময় ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমার টিজারের প্রশংসা করে সেলিম খান বলেন, “আমি সম্প্রতি একটি সিনেমার টিজার দেখেছি। ‘অপারেশন সুন্দরবন’। টিজারটি দেখে প্রশংসা না করে পারি না। আমার মনে হয় ‘অপারেশন সুন্দরবন’ রিলিজ হলে সিয়ামই হবে বাংলাদেশের সুপারস্টার। আমার মনে হয় ২০ কোটি লোকে এই সিনেমাটা দেখবে যখন দেশের হলগুলোতে সিনেমাটি রিলিজ হবে। এবং আমি মনে করি, শাকিব খান সুপারস্টার নয়; সুপারস্টার হবে সিয়াম। আপনারা আমার কথাটা মিলিয়ে নিয়েন। আমি কিন্তু সিয়ামকে নিয়ে একটা সিনেমাও করিনি। সে কিন্তু আমার হাউজে কাজ করেনি। আমি তাকে চিনি। কিন্তু কখনো কথা হয়নি। তবুও এই প্রশংসাটা আজ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে করলাম।”
শাকিব ও সিয়াম তো দুই প্রজন্মের নায়ক। তাদের ক্যারিয়ারের পার্থক্যটা তো অনেক। দুজনকে একসঙ্গে মিলিয়ে ফেলা তো ঠিক নয়। এই প্রসঙ্গে সেলিম খান বলেন, ‘আমি জানি দুজন দুই সময়ের। আমি এই সময়ের কথা বলছি। দেখেন শাকিব খানকে নিয়ে যত প্রডিউসার সিনেমা বানিয়েছে তার যত প্রযোজক লস করেছে সবকিছুর জন্য একমাত্র শাকিব খান দায়ী। আপনারা দেখেন, সিনেমা এখন কম হচ্ছে, পরিচালকের সিনেমা বানাতে টাইম বেশি লাগতেছে, প্রযোজকের খরচ বাড়তেছে কারণ একটাই।
শাকিব খান। একজন পরিচালক প্রযোজকের সঙ্গে বসে চকআউট করে যে কোনো আর্টিস্ট কয়দিন শুটিং করবে। সব ঠিক করে মাঠে নামার পর প্যাঁচ লাগান এই শাকিব খান। ৮টায় কল, আসেন ৫টায়। দুই ঘণ্টাও কাজ করেন না। সিনেমা বানাতে সময় বাড়ে। কষ্ট বাড়ে। ধরাটা খায় কে? প্রযোজক। এভাবে প্রযোজক হারিয়ে যায়। অনেক অনেক প্রযোজক হারিয়ে গেছে। দিনে দিনে এভাবে প্রযোজক হারাইছে, সিনেমা কমছে তার মূলে এই শাকিব খান।’
নদী বন্দর / এমকে