১৯৯১ সালের ক্রিসমাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্বের পতন ঘটার আগে এর শেষ নেতা মিখাইল গর্ভাচেভ বলেন, যদিও ভবিষ্যত অনিশ্চিত তবে আমরা অন্তত অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং দেশের বাইরে সৈন্য ব্যবহার করার অভ্যাস ত্যাগ করব।
কিন্তু ৩০ বছর পর সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী রাশিয়াই ভিনদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। বেলারুশের রাজনীতিতে নানা ভাবে হস্তক্ষেপ করছে রাশিয়া। এমনকি দেশটির প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পেছনের কারীগরও যে পুতিন সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
গত এপ্রিলে ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে রাশিয়া। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রুশ ফেডারেশনে একীভূত করার সময় ওই উপত্যকায় রাশিয়ার যত সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল এবার সে সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। আমেরিকা ও ন্যাটোর উসকানিমূলক পদক্ষেপ মোকাবিলায় সামরিক মহড়া চালানোর লক্ষ্যে সীমান্তে এসব সেনা পাঠানো হয়েছে।
এরপর চলতি মাসের শুরুর দিকে ইউক্রেন নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই আলোচনায় বসেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইউক্রেন সীমান্তের কাছে ৯৪ হাজারেরও বেশি রুশ সেনা মোতায়েনের পর থেকেই এই দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়।
সে সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনে ‘বড় আকারে’ হামলার পরিকল্পনা করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন প্রমাণ রয়েছে। তবে তিনি আরও বলেন, পুতিন হামলার চূড়ান্ত সীদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে রাশিয়া।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তের বেশ কিছু উপগ্রহ চিত্র তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি সংস্থা ম্যাক্সার টেকনোলজিস। এসব ছবিতে দেখা গেছে, ক্রিমিয়া ও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে একাধিক জায়গায় রুশ সেনাবাহিনীর সংখ্যা বেড়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো খুব শিগগির ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারেন। তাকে এই হামলা থেকে কিভাবে প্রতিহত করা যায় সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
ইউক্রেনকে রক্ষা করতে ন্যাটো দেশগুলোর সামরিক হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। তারা সেটা করবে না এবং করা উচিতও হবে না। কারণ কেউই পরামাণু-সামরিক অস্ত্র সমৃদ্ধ রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না।
এক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো উপায়েই পুতিনকে ইউক্রেনে হামলা চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। এর মধ্যে কিছু হতে পারে আর্থিক। গত ৭ ডিসেম্বর পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বাইডেন তাকে সতর্ক করেছিলেন যে, ইউক্রেনে পুনরায় হামলা চালানো হলে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আনা হবে।
সামরিকভাবেও রাশিয়াকে আক্রমণ চালানো থেকে প্রতিহত করা সম্ভব। যদিও রাশিয়া সহজেই ইউক্রেনে হামলা চালাতে সক্ষম। ইউক্রেনকে আরও দৃঢ় হতে হবে। আর ইউক্রেনে পশ্চিমা দেশগুলোকে আরও বেশি আর্থিক সহায়তা এবং প্রতিরক্ষা অস্ত্র সহায়তা দেওয়া উচিত। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার পদক্ষেপ থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ইউক্রেনের অধিকাংশ মানুষই তাদের দেশে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ মেনে নেবে না।
একই সময়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের উচিত সংঘাত কমিয়ে আনার উপায় খুঁজে বের করা। তবে সেটাও কঠিন কারণ পুতিনের অনেক দাবিই যুক্তিসঙ্গত নয় বা এতে আন্তরিকতার কোনো বালাইও থাকে না। তার দাবি রাশিয়ার জন্য বড় হুমকি ন্যাটো। কিন্তু ন্যাটো এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
তিনি এই দাবি করেছেন কারণ তার দেশের সীমান্তেই একটি কার্যকরী, গণতান্ত্রিক ইউক্রেন তার কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে এবং কারণ কাল্পনিক বহিরাগত শত্রুদের হাত থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করার বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে তিনি সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে নিজের দেশের কাছে পুতিন বেশ সফলই বলা যায়। কারণ তার দেশের মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ মনে করে যে পূর্বাঞ্চলীয় ইউক্রেনের সঙ্গে উত্তেজনার পেছনে রাশিয়া দায়ী। তবে অর্ধেকের মতো মানুষ মনে করে এর পেছনে আমেরিকা এবং ন্যাটো দায়ী।
পুতিনের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে বাইডেনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয় এবং তাদের এই আলোচনা চালিয়ে নেওয়া উচিত। তাছাড়া ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাই এসব বিষয় নিয়ে রাশিয়ার আরও ভাবা উচিত।
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যকার এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির আসলে পরিষ্কার কোনো সমাধান এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণে দুপক্ষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়াটাই উত্তম কৌশল হবে। আর ইউক্রেন সরকারকেও সরাসরি আলোচনায় অংশ নিতে হবে। পুতিন যেন ইউক্রেনকে পশ্চিমা দেশগুলোর হাতের পুতুল মনে না করে। কারণ তারা আসলেও তা নয়। এছাড়া ছোটখাট কোনো সংঘাতের ক্ষেত্রেও পুতিনকে আকৃষ্ট করা উচিত হবে না।
তিনি হয়তো হিসেব করে রেখেছেন যে, ইউক্রেনকে আক্রমণ করার পরিবর্তে শুধু হুমকি দিলে রাশিয়ার কতটা লাভ বা ক্ষতি হবে। কিন্তু ছোট ছোট আগ্রাসন খুঁজে বের করতে তিনি বেশ পারদর্শী। তবে বরাবরই এসব বিষয় প্রত্যাখ্যানও করে আসছেন পুতিন। যতদিন পর্যন্ত রাশিয়ার দায়িত্বে পুতিন আছেন ততদিন প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য রাশিয়া বিপজ্জনকই থেকে যাবে।
নদী বন্দর / এমকে