গত গ্রীষ্মে জাহাজ সংকট যখন চরমে, তখন ইতালিতে কয়েক হাজার লিপস্টিক তড়িঘড়ি করে একটি কার্গো প্লেনে তোলা হয়। সেগুলো অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে হতো। ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক বিউটি ব্র্যান্ড ট্রু প্লাস লুসিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী মেহির শেঠি জানান, তিনি বহু বছর ধরে সমুদ্রপথে মালামাল পরিবহনে অভ্যস্ত। এটি সবসময়ই নির্ভরযোগ্য। কিন্তু ওই ১৫ হাজার লিপস্টিক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্রাহকদের হাতে পৌঁছাতে প্লেনে পাঠানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না তার।
মেহির বলেন, কষ্ট হলেও সেবার সময় কম থাকা দুটি চালানে আমাকে এই কাজটি করতে হয়েছে। এসব পণ্য অনেক আগেই খুচরা বিক্রেতাদের হাত পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছিল। শেষপর্যন্ত কিছুটা আর্থিক ক্ষতি মেনে নিয়ে আকাশপথে লিপস্টিকগুলো যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। তবে গ্রাহক ধরে রাখতে এর দরকার ছিল বলে মনে করছেন ট্রু প্লাস লুসিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা।
গত কয়েক মাসে এমন উদাহরণ তৈরি হয়েছে ভুরিভুরি। আর তা থামার আপাতত কোনো লক্ষণ নেই। স্পোর্টসওয়্যার ব্র্যান্ড আন্ডার আর্মারের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার ডেভিড বার্গম্যান গত নভেম্বরেই বলেছিলেন, আমরা আকাশপথে প্রচুর মালামাল পরিবহন করছি, যা নিয়ে আমি মোটেও খুশি নই। কিন্তু আমরা সবাই যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি, তার জন্য এটি প্রয়োজন।
একইভাবে ইস্টম্যান কেমিক্যাল কোম্পানিও তাদের প্লাস্টিক পরিবহনে কার্গো প্লেন ব্যবহারের কথা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে কার্গো প্লেন চলাচলের হিসাব রাখা ইউএসএ ট্রেড অনলাইন নামে একটি সংস্থা জানিয়েছে, ২০২১ সালের প্রথম ১০ মাসে এশিয়া থেকে ৭ কোটি ৮৯ লাখ কেজি গাড়ি যন্ত্রাংশ এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। অথচ এক বছর আগে একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৩০ লাখ কেজি।
আকাশপথে মালামাল পরিবহন বরাবরই ব্যয়বহুল। এখন তা রীতিমতো আকাশ ছুঁয়েছে। আইএইচএস মার্কিটের মালিকানাধীন জার্নাল অব কমার্সের সিনিয়র ইউরোপ এডিটর গ্রেগ নোলারের কথায়, এশিয়া থেকে উত্তর আমেরিকায় কার্গো প্লেনে মালামাল পরিবহনের খরচ দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজিতে ১৫ মার্কিন ডলার, যা মাথানষ্ট করার মতো বেশি। এমনটি আগে কোনোদিন দেখিনি।
এ অবস্থার জন্য সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে বিলম্বকে দায়ী করা যায়। তবে যাত্রীবাহী ফ্লাইট ব্যাপকভাবে কমে যাওয়াও কম দোষী নয়। বিশ্বজুড়ে আকাশপথে অর্ধেকেরও বেশি পণ্য পরিবহন হয় মূলত যাত্রীবাহী প্লেনের ‘বেলি কার্গো’র মাধ্যমে। কিন্তু সেই জায়গা অনেক কমে যাওয়ায় বাড়তি চাহিদা মেটাতে এয়ারলাইনগুলো যাত্রীবাহী প্লেনকে মালবাহীতে রূপান্তর করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমনকি অবসরে পাঠানো পুরোনো প্লেনগুলোকেও কাজে ফেরানো হচ্ছে।
রাশিয়ার বৃহত্তম কার্গো এয়ারলাইন ভলগা-ডিনেপ্রর অধীনস্থ এয়ারব্রিজকার্গোর বাণিজ্যিক পরিচালক অ্যালেক্সেই জোতভ জানিয়েছেন, তাদের চাহিদা অভূতপূর্ব হারে বেড়েছে। এ কারণে বহরে নতুন করে ছয়টি প্লেন যোগ করা হচ্ছে।
এয়ার কানাডার মতো কিছু এয়ারলাইন বহরে কার্গো প্লেন বাড়াতে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, সেগুলোর রঙের কাজ শেষ হওয়ার আগেই আকাশে ওড়ানো শুরু হয়ে যাচ্ছে। এয়ারবাসের মতো প্লেন নির্মাতাদের কাছেও যাত্রীবাহী প্লেনে পণ্য পরিবহনের জায়গা বাড়ানোর অনুরোধ আসছে। সেক্ষেত্রে যাত্রীদের সিট কমানো ও তুলনামূলক বড় দরজা লাগানোর দাবি বাড়ছে।
এয়ারবাসের ফ্রেইটনার মার্কেটিংয়ের হেড অব মার্কেটিং ক্রফোর্ড হ্যামিল্টন বলেন, আমরা দেখছি, অনেক লোক এই রূপান্তরিত প্লেনগুলো কিনছে। সেগুলো পরের দুই-তিন বছরের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা দু’বছর আগেও ছিল না।
পরিমাণের দিক থেকে বৈশ্বিক পণ্য পরিবহনের মাত্র ১ শতাংশ হয় আকাশপথে, কিন্তু খরচের দিক থেকে হিসাব করলে তা প্রায় ৩৫ শতাংশ। সাধারণত ইলেক্ট্রসিকস ও ফ্যাশন পণ্যের মতো বাজারে সীমিত সময় থাকা দামি জিনিসগুলো আকাশপথে পাঠানো হয়। তাছাড়া, মহামারির মধ্যে এ ধরনের প্লেন অগণিত টিকা ও সুরক্ষা উপকরণ পরিবহন করেছে।
বিপুল চাহিদার কারণে সম্প্রতি এয়ারবাস পাঁচটি বেলুগা এসটি প্লেন নিয়ে এয়ার-কার্গো সার্ভিস চালু করেছে। বিশাল আকার আর গঠনশৈলীর কারণে এই প্লেনগুলোকে ‘ফ্লাইং হোয়েলস’ (উড়ন্ত তিমি) বলা হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, কার্গো প্লেনের এই বাড়তি চাহিদা কতদিন থাকবে? মহামারি শেষ হলে চাহিদা কমে যাবে না তো? প্লেন নির্মাতারা অবশ্য এ বিষয়ে আশাবাদী।
এয়ারবাস আশা করছে, আগামী বছরগুলোতে তাদের কার্গো সেবার চাহিদা বাড়বে। সেই বিশ্বাস থেকে সম্প্রতি তারা এ৩৫০এফ প্লেন উদ্বোধন করেছে। প্লেনটি বোয়িং ৭৪৭-এর সমান পণ্য পরিবহন করতে পারলেও এর জ্বালানি খরচ অন্তত ৪০ শতাংশ কম।
কার্গো ব্যবসা নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছে বোয়িংও। প্রতিষ্ঠানটি পূর্বাভাস দিয়েছে, এখন থেকে ২০৩৯ সালের মধ্যে এয়ার-কার্গোর ব্যবহার অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়বে। আর সেই চাহিদা পূরণ করতে হলে নির্মাতাদের অন্তত ২ হাজার ৪০০টি নতুন কার্গো প্লেন তৈরি করতে হবে।
সূত্র: বিবিসি
নদী বন্দর / এমকে