‘নদী রে ও নদী রে তুই একটু দয়া কর, ভাঙিস না আর বাপের ভিটা বসত বাড়িঘর’ নদী ভাঙন নিয়ে এমন অনেক গানের সুর পদ্মা নদীর কানে না পৌঁছালেও তা যেন পাড়ের বাসিন্দাদের বুকে গিয়ে বিঁধছে। বছর ঘুরলেই খরস্রোতা এ নদীর ভাঙন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। বর্ষা এলেই নদীপাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক যেন বেড়েই চলে।
চলতি বর্ষায় দেশের পদ্মা নদীর পানি বেড়েই চলছে। স্রোতও যে হিংস্র হয়ে উঠেছে। ফলে ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। গত ১৫ দিনে ইউসুফ মাতব্বরের ডাঙ্গী এলাকায় কয়েকশ পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। পদ্মা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অন্তত ১০-১৫ একর ফসলি জমি। এছাড়া একই ইউনিয়নের সোবহান ফকিরের ডাঙ্গীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের সবারই চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের।
স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর পদ্মা নদীর ভাঙনে দিশেহারা থাকেন পদ্মানদী বেষ্টিত নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের বাসিন্দারা। ভাঙনকবলিত এসব এলাকার মানুষ তাদের শেষ সম্বলটুকু এখন সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাড়ি-ঘর, কেটে নিচ্ছেন গাছপালা। পদ্মার তাণ্ডবে বিগত তিন মাসের ব্যবধানে দেড় শতাধিক বসতবাড়ি, কয়েকশ একর ফসলি জমি, কয়েক কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া বর্তমানে ভাঙনের ঝুঁকির মুখে আছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি পাকা মসজিদ। এদিকে ভাঙন রোধে গত বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার জানান, এলাকার মো. মাইমুদ্দিন মোল্লা, আলী তালুকদার, মোকা তালুকদার, লাল মোল্লা, কবির খলিফা, আলতাফ মিয়া, জহিরুল শেখ, শহীদ শেখ, আলেপ শেখ, রাকিব মোল্লাসহ দেড় শতাধিক পরিবার বসতভিটা হারিয়েছেন। ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে সূর্য শেখ, আমজাদ শেখসহ আরও অন্তত শতাধিক পরিবারের বাস্তুভিটা। এছাড়া মাত্র ১২০ মিটার দূরে আছে চর টেপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি পাকা মসজিদ। খুব অল্প সময়ে মধ্যে হয়তো এসব প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
ওই গ্রামের আশি বছরের বৃদ্ধ রশিদ খাঁ বলেন, আমাদের মনে শান্তি নেই, চোখে ঘুম নেই। পদ্মায় সব শেষ করে দিয়েছে। বাড়ি-ঘর ভেঙে সরিয়ে নিতে হয়েছে, এখন ভিটের সামনে বসে থাকি। হয়তো দুই এক দিনের মধ্যে নদীগর্ভে হারিয়ে যাবে। কোথায় যাবো, কি করবো কিছুই ভাবতে পারছি না।
ইউসুফ মাতব্বরের ডাঙ্গী গ্রামের আমজাদ শেখ বলেন, এ পর্যন্ত অন্তত ছয়বার পদ্মা নদী ভাঙনে বসতবাড়ি সরিয়ে নিতে হয়েছে। সর্বশেষ সাতবার বসতবাড়িটি সরাতে হচ্ছে। এ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার মতো নয়, বর্ণনা করার মতো নয়। নদী ভাঙনের শিকার মানুষগুলোই কেবল এ কষ্ট বুঝবে।
স্থানীয় কৃষক লালন শেখ বলেন, আমার দুই একর ফসলি জমি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বিলীন হয়েছে শেষ সম্বল বসতভিটাও।
আরেক বাসিন্দা মাইমুদ্দিন মোল্লা বলেন, পদ্মা নদী ভাঙনে আমার এক একর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙতে ভাঙতে বাড়ির কাছে চলে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই।
চর টেপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকান্ত ঘোষ বলেন, স্কুল থেকে ভাঙনের দূরত্ব মাত্র ১২০ মিটার। পদ্মা নদী ভাঙনের পরিস্থিতি জানিয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর লিখিত চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে নর্থ চ্যানেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য পায়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে। ভাঙনরোধে কাজ শুরু করা হয়েছে। তবে তা সীমিত আকারে সীমিত জায়গায়। ভাঙনের ব্যাপকতা এতটাই বিস্তৃতি যে, একদিকে কাজ করা হলে অন্যদিক ভেঙে যাচ্ছে। পদ্মায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। গত ১৫ দিনে কয়েকশত পরিবার তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
ফরিদপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, নদী ভাঙন রোধে প্রাথমিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভাঙনকবলিত এলাকার ১৫৩ মিটার অংশে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ চলছে। এরই মধ্যে ২৫০ কেজি বালুভর্তি ৬ হাজার ২০৯টি এবং ১৭৫ কেজি বালুভর্তি ১ হাজার ৩৪৩টি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি নদী ভাঙনরোধে জরুরি ভিত্তিতে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।
নদী বন্দর/এসএইচবি