ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ক্ষমতা হারানোর দিন দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আন্দোলনের সময়কার অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াল-এর নির্বাহী সম্পাদক অমল সরকারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
এটি শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ওবায়দুল কাদেরের দেওয়া প্রথম কোনো বিস্তৃত সাক্ষাৎকার। সেদিনের বর্ণনা করে কাদের জানান, গণভবন ঘিরে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন হঠাৎই সংসদ এলাকা এবং আশপাশের বাসাবাড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, আমার নিজের বাসায় হামলার আশঙ্কায় পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম নিরাপদ, কিন্তু সেখানেও হামলা হয়। ভাঙচুর শুরু হলে আমি স্ত্রীসহ বাথরুমে লুকিয়ে থাকি। প্রায় ৫ ঘণ্টা ভেতরে ছিলাম।
কাদের জানান, বিক্ষোভকারীরা বাসার বাথরুম পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। তার স্ত্রী বারবার অনুরোধ করে তাদের থামানোর চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা বাথরুমে ঢুকে পড়ে, কিন্তু কাদেরকে দেখে আচরণ পাল্টে যায়।
‘তারা বলল, নেত্রী চলে গেলেন, আপনি যাননি কেন? এরপর সেলফি তুলতে শুরু করে। কয়েকজন আবার বলছিল, আমাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে, কেউ বলছিল জনতার হাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে একটা মাস্ক আর ব্যাচ পরিয়ে সেখান থেকে নিরাপদে বের করে। একটা ইজিবাইকে তুলে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে নিয়ে যায়, বলেন তিনি।
এই ঘটনাকে কাদের বর্ণনা করেন ‘একটা অলৌকিক রকমের ভাগ্যজয়’ হিসেবে। বলেন, সেদিন বেঁচে যাওয়া সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল।
এরপরের তিন মাস তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন শ্রমিক ও কর্মচারীদের অসন্তোষ কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে। জানান, প্রতিদিন দেখি গার্মেন্টস সেক্টরে আন্দোলন। ভাবছিলাম, কিছু করা যায় কিনা। কিন্তু একে একে সবাই গ্রেফতার হচ্ছিল। আমার বিরুদ্ধে বহু মামলা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিই, নিরাপত্তার কারণে দেশ ছাড়তে হবে।
সাক্ষাৎকারে ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ বা যুবলীগকে মাঠে নামানোর নির্দেশ তিনি দেননি। বরং পরিস্থিতির চাপেই দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার ভূমিকা নিতে হয়েছিল।
‘আমি কখনো বলিনি ছাত্রলীগ দিয়ে অভ্যুত্থান ঠেকাতে হবে। কেউ কেউ ভিডিও ক্লিপ কেটে এই প্রচার চালিয়েছে। আমার বক্তব্যে ছাত্রলীগের নামই ছিল না’—বলেন তিনি।
তিনি জানান, গণভবন, সেতু ভবন, বিটিভি ভবন, এমনকি আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়েও হামলা হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে নিজের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছেন মাত্র। বলেন, আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও একই কাজ করত।
কাদের স্বীকার করেন, এই অভ্যুত্থান ছিল আকস্মিক এবং গোয়েন্দা ব্যর্থতাও ছিল। ‘ঘটনার শুরুটা কোটা আন্দোলন দিয়ে হলেও শেষটা হয়েছে একদফা দাবিতে। এটা অনেকটা বিস্ফোরণের মতো ঘটেছে’, বলেন তিনি।
নিজের ভুল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নেত্রী যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি সেভাবেই কাজ করেছি। ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে, তবে আমি কখনো চাঁদাবাজি বা কমিশন খাইনি। পদ দেওয়ার বিনিময়ে কাউকে টাকা দিতে হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে, সব সত্য নয়। তবে আমরা যা করেছি, তা দেশের উন্নয়নের স্বার্থে। যারা দিনের আলোতে অন্ধকার দেখে, তারা এসব সমালোচনা করে। সময় হলে সবকিছুর মূল্যায়ন হবে।’
দীর্ঘদিন নীরব থাকার কারণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, মূলত স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণেই তিনি ছিলেন চুপ। ‘প্রধানমন্ত্রী নিজেই আমার খোঁজ নিয়েছেন। তিনি সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন আমার অসুস্থতা নিয়ে’, বলেন ওবায়দুল কাদের।
দলের ভেতর বিরোধ বা প্রতিযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমাকে তিনবার সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। এটা অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে স্বাভাবিক বিষয়।
অতীতের কলকাতা প্রবাস, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পালিয়ে থাকা, ওয়ান ইলেভেনের সময়কার জেলজীবন নিয়েও কথা বলেন কাদের। তিনি জানান, এসব সময়েও দলের সঙ্গে ছিলেন এবং দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমি ভুল করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। কাজ করেছি, নেত্রীর নির্দেশে। ভুল থাকলে সময়ই বিচার করবে।
নদীবন্দর/জেএস