আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি একটি মন্তব্য করেছেন, যা ঘিরে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্পের বক্তব্যের পর তালেবান কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, সেইসঙ্গে বিরলভাবে একসঙ্গে অবস্থান নিয়েছে আফগানিস্তানের প্রায় সব প্রতিবেশী দেশ—ভারত, পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, ইরানসহ আরও কয়েকটি দেশ। তারা একযোগে বলেছে, আফগানিস্তানে আর কোনো বিদেশি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বরদাশত করা হবে না।
যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, বাগরাম ঘাঁটি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু তা বিনামূল্যে তালেবানদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেন, ‘যদি আফগানিস্তান এই ঘাঁটি ফেরত না দেয়, তাহলে খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারে।’ তার এই বক্তব্য তালেবান কর্তৃপক্ষ এবং পুরো অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করে।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে তালেবান পুনরায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। কাবুলের উত্তরে অবস্থিত বাগরাম ঘাঁটি বহু বছর ধরে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ঘাঁটিটির দুটি বিশাল রানওয়ে এবং অস্ত্রবাহী সামরিক বিমান ওঠানামার সুযোগ থাকায় এটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তালেবান দ্রুত ট্রাম্পের দাবির বিরোধিতা করে জানায়, কোনো পরিস্থিতিতেই তারা বাগরাম ঘাঁটি বা আফগানিস্তানের কোনো স্থাপনা তৃতীয় কোনো দেশের হাতে তুলে দেবে না। এটি শুধু সার্বভৌমত্বের প্রশ্নই নয়, বরং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক বৈধতার বিষয়।
এই পটভূমিতে মস্কোতে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে একত্রিত হন চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তানের কর্মকর্তারা। তারা আফগানিস্তানে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে একযোগে অবস্থান নেন। যদিও তারা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করেনি, তবে ট্রাম্পের মন্তব্যের পর সময় ও প্রেক্ষাপট দেখেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। চীন ও রাশিয়ার মতো শক্তিগুলোর আশঙ্কা—ওয়াশিংটনের প্রত্যাবর্তন মানে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশও চায় না, আফগানিস্তানে আবার বাইরের শক্তির প্রভাব বাড়ুক। তাদের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এই অঞ্চলের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
মধ্য এশিয়ার তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তানের উদ্বেগ আবার ভিন্ন। তারা ভয় পাচ্ছে, বাগরামে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপিত হলে তা তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় সহিংস গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমকে উসকে দিতে পারে। অনেক দেশের আশঙ্কা, আফগানিস্তান আবারো বিদেশি শক্তির ‘প্রক্সি যুদ্ধের ময়দান’ হয়ে উঠবে। বিশেষ করে ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ (আইএসকেপি), তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এবং বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) মতো সংগঠন আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই মন্তব্য তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের এক শীর্ষ বিশ্লেষক কামরান বোখারির মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভূকৌশলগত নীতিতে আফগানিস্তানে আবার সেনা মোতায়েনের কোনো পরিকল্পনা নেই। বরং মার্কিন নীতিতে সামরিক সংকোচনই এখন প্রধান লক্ষ্য।
রাশিয়ার জন্য এই মুহূর্তে মস্কো বৈঠক ছিল মধ্য এশিয়ায় তাদের অবস্থান জোরদার করার কৌশল। আর চীনও চায়, আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক, যাতে তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) বিনিয়োগ হুমকির মুখে না পড়ে। অন্যদিকে ইরান যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে চায় না, তাদের প্রতিবেশী দেশে আবার মার্কিন ঘাঁটি ফিরে আসুক।
ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি স্পর্শকাতর। কারণ, চীন ও পাকিস্তান উভয়ের প্রভাব থাকায়, আফগানিস্তানে কোনো তৃতীয় পক্ষের সামরিক উপস্থিতি ভারতের আঞ্চলিক কৌশলকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। পাকিস্তানও ট্রাম্পের দাবির বিরোধিতা করলেও তালেবানের কার্যকারিতা নিয়ে ক্রমাগত হতাশ। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় টিটিপি-র বাড়বাড়ন্ত এবং তালেবান সরকারের ব্যর্থতা পাকিস্তানকে ভুগিয়েছে।
তবে বাস্তবতায়, অধিকাংশ দেশ তালেবান সরকারকে এখনো স্বীকৃতি না দিলেও, সম্পর্ক গভীর করছে। কারণ তারা জানে, আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণ একঘরে করে রাখা গেলে তা বরং আরও বিপর্যয় ডেকে আনবে। ফলে তারা চায়, কূটনৈতিক স্বীকৃতি না দিলেও, তালেবানের সঙ্গে বাস্তবধর্মী যোগাযোগ ও বোঝাপড়া বজায় রাখতে।
তালেবান সরকারের জন্যও ট্রাম্পের দাবি এক ধরনের চাপে ফেলেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা ঝুঁকিতে পড়ছে। অন্যদিকে বাগরাম ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিলে অভ্যন্তরীণভাবে বিরোধিতা ও ক্ষোভের মুখে পড়বে। এমনকি তালেবানের নিজেদের ভেতরেই ফাটল ধরতে পারে।
সব মিলিয়ে বাগরাম ঘাঁটি এখন শুধু একটি সামরিক স্থাপনা নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক কৌশলের প্রতীক। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ, অন্যদিকে আঞ্চলিক দেশের বিরোধিতা ও তালেবানের প্রতিরোধ, এই টানাপোড়েনে বাগরাম আফগান ভূরাজনীতির অন্যতম স্পর্শকাতর ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
সূত্র: আল জাজিরা
নদীবন্দর/এএস