লক্ষ্য ২২১ রানের। হিমালয়ে ওঠার মিশনে মাত্র ৩১ রানেই সাজঘরে প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যান। যে কেউ হয়তো তখনই লিখে ফেলবে ব্যাটিং দলের এপিটাফ। কিন্তু সেই দলে যদি থাকে আন্দ্রে রাসেল নামের খেলোয়াড়, তাহলে শেষ লেখার আগে কয়েকবার ভাবতে হবে নিশ্চয়ই!
নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন ঠিকই রাসেল। কলকাতা নাইট রাইডার্সের টপঅর্ডার ব্যাটসম্যানদের রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে খেলেছেন ২২ বলে ৫৪ রানের টর্নেডো ইনিংস। পরে ঝড় তুলেছেন অস্ট্রেলিয়ান পেস বোলিং অলরাউন্ডার প্যাট কামিনস। তার সংগ্রহ ক্যারিয়ার সেরা ৩৪ বলে ৬৬ রান।
তবু তা যথেষ্ঠ হয়নি চেন্নাই সুপার কিংসের করা ২২০ রানের সংগ্রহকে টপকে যেতে। শুরুর ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর রাসেল-কামিনস ঝড়, তবু কলকাতাকে থামতে হয়েছে ২০২ রানে। তখনও বাকি ছিল ইনিংসের ৫টি বল। কিন্তু অলআউট হয়ে যাওয়ায় মিলেছে ১৮ রানের পরাজয়।
এ নিয়ে পাঁচ ম্যাচে তৃতীয়বারের মতো হার নিয়েই মাঠ ছাড়তে হলো শাহরুখ খানের দলকে। মাত্র দুই জয় নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের ছয় নম্বরে নেমে গেছে তারা। অন্যদিকে জয়ের হ্যাটট্রিক করে চার ম্যাচে ৬ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে উঠে গেছে মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই সুপার কিংস।
সিনেমার গল্পেও হয়তো এতো রোমাঞ্চ আর অনিশ্চয়তা রাখেন না গল্পকাররা, যতটা ছিল চেন্নাই ও কলকাতার মধ্যকার এই ম্যাচে। আগে ব্যাট করা চেন্নাইয়ের পক্ষে ফাফ ডু প্লেসি করেন ৯৫ রান। মাত্র ৫ রানের জন্য বঞ্চিত হন নিজের সেঞ্চুরি থেকে।
ডু প্লেসি একাই খেলেন ৬০ বল। বাকি ৬০ বল থেকে আসে আরও ১২৫ রান। যেখানে বড় অবদান রুতুরাজ গাইকঁদ (৪২ বলে ৬৪), মঈন আলি (১২ বলে ২৫) ও অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির (৮ বলে ১৭)। এমনকি মাত্র এক বল খেলে সেটিতেই ছক্কা হাঁকান রবীন্দ্র জাদেজা।
যার ফলে প্রথম দশ ওভারে মাত্র ৮২ রান করা চেন্নাই, শেষ দশ ওভারে যোগ করে ১৩৮ রান। সময়ের অন্যতম সেরা পেসার প্যাট কামিনস তার ৪ ওভারে খরচ করেন ৫৮ রান। এই ম্যাচের আগপর্যন্ত ভালো বোলিং করা প্রাসিদ কৃষ্ণার ৪ ওভারে খরচ হয় ৪৯ রান।
চেন্নাই ২২০ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করালেও, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে প্রায় সময়ই নিরাপদ হয় না এ রান। তবে দলকে নির্ভার করতে জাদুকরী এক প্রথম স্পেল উপহার দেন ডানহাতি পেসার দ্বীপক চাহার। পাওয়ার প্লে বিশেষজ্ঞ চাহারের আক্রমণে ছয় ওভারেই দিশেহারা হয়ে পড়ে কলকাতার ব্যাটিং।
প্রথম ওভারের চতুর্থ বলে শুভমান গিল, তৃতীয় ওভারের পঞ্চম বলে ফর্মে থাকা নিতীশ রানা, পঞ্চম ওভারের তৃতীয় বলে অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যান ও শেষ বলে সুনিল নারিনকে সাজঘরের ঠিকানা হাতে ধরিয়ে দেন চাহার। পাওয়ার প্লে’র শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলে রাহুল ত্রিপাঠিকে ফিরিয়ে কলকাতার পঞ্চম উইকেটটি নেন লুঙ্গি এনগিডি।
তখন ৫.২ ওভার শেষে কলকাতার সংগ্রহ ৫ উইকেটে ৩১ রান। ঠিক এই জায়গা থেকেই পাল্টা আক্রমণ শুরু রাসেলের। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ও কলকাতার সাবেক অধিনায়ক দীনেশ কার্তিককে সঙ্গে নিয়ে মাত্র ৬ ওভারে ৮১ রানের জুটি গড়েন এ ক্যারিবীয় দানব।
শুরুটা করেন লুঙ্গির করা ষষ্ঠ ওভার থেকেই। সেই ওভারের শেষ চার বলে দুই চার ও এক ছয়ে নিয়ে নেন ১৪ রান। পরে চাহারের ব্যক্তিগত শেষ ওভারে দুই ছয়ের মারে আসে আরও ১৩ রান। ফলে ৮ ওভারে দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ৬৬ রান।
নবম ওভারে দারুণ বোলিং করেন বাঁহাতি স্পিনার জাদেজা, খরচা মাত্র ৭ রান। জাদেজার ওভারে বেশি রান করতে না পারার ঝালটা পরের ওভারে শার্দুল ঠাকুরের ওপর দিয়ে তোলেন রাসেল। সেই ওভারে দুই চার ও দুই ছয়ের মারে আসে ২৪ রান। ওভারের তৃতীয় বলে চাবুকের মতো শটে অবিশ্বাস্য এক ফ্ল্যাট ছয় হাঁকান রাসেল।
জাদেজার পরের ওভার থেকে আসে ১৪ রান। সেই ওভারের প্রথম বলে বাউন্ডারি হাঁকান কার্তিক আর শেষ বলে ছক্কা মেরে মাত্র ২১ বলে ব্যক্তিগত পঞ্চাশ রানে পৌঁছে যান রাসেল। যার সুবাদে ১১ ওভারে লক্ষ্যের অর্ধেক রান করে ফেলে কলকাতা, স্কোর দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ১১১ রান।
ঠিক তখনই নিজের তুরুপের তাসটা খেলেন চেন্নাই অধিনায়ক ধোনি। সবাই যখন অপেক্ষায় ছিলেন আরেক স্পিনার মঈন আলির আক্রমণে আসার, তখন ধোনি বল তুলে দেন বাঁহাতি পেসার স্যাম কারানের হাতে। এমনভাবে ফিল্ড সাজান, যেন ওয়াইড ইয়র্কার করবেন কারান।
কিন্তু বিধিবাম! রাসেলকে ধোঁকায় ফেলে লেগস্ট্যাম্পের ওপর লেন্থ ডেলিভারি করেন কারান। ওয়াইড হবে ভেবে ছেড়ে দেন রাসেল। বল সোজা গিয়ে আঘাত হানে লেগস্ট্যাম্পে, বাজে রাসেলের ৩ চার ও ৬ ছয়ের মারে খেলা ২২ বলে ৫৪ রানের ইনিংসের বিদায় ঘণ্টা।
রাসেল ফিরে গেলেও সেই ওভারের শেষ দুই ছয়-চারে ১০ রান নিয়ে কলকাতাকে লক্ষ্যেই রাখেন কার্তিক। তার সঙ্গে লড়াইয়ে যোগ দেন কামিনস। এরই মাঝে ১৩তম ওভারে শেষবারের মতো আক্রমণে এসে মাত্র ৪ রান খরচ করেন জাদেজা। তার ৪ ওভারে আসে মোট ৩৩ রান।
এরপর খানিক ধীর হয়ে আসে কলকাতার ইনিংস। শার্দুল ঠাকুরের করা ১৪তম ওভারে ১১ ও লুঙ্গির করা ১৫তম ওভারে হয় মাত্র ৮ রান। এর চেয়েও বড় ধাক্কা হয়ে আসে লুঙ্গির ওভারের শেষ বলে কার্তিকের লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়া। আউট হওয়ার আগে ৪ চার ও ২ ছয়ে ২৪ বলে ৪০ রান করেন কার্তিক।
তখনও জয়ের জন্য ৩০ বলে ৭৫ রান প্রয়োজন ছিল কলকাতার, হাতে উইকেট ছিল মাত্র ৩টি। শেষদিকের বোলারদের নিয়েই অসম লড়াইয়ে নেমে যান কামিনস। আর সেই লড়াইয়ে স্যাম কারানের করা ১৬তম ওভারে ইনিংসের সর্বোচ্চ ৩০ রান তুলে নেন এ অসি অলরাউন্ডার।
আগের ওভারে রাসেলকে ফেরালেও, এই ওভারে কামিনসের সামনে নিজের লাইন-লেন্থ সব গুলিয়ে ফেলেন কারান। ওভারের প্রথম বলে আসে ২ রান। এরপর ছক্কার হ্যাটট্রিক করেন কামিনস। পঞ্চম বলটি এক্সট্রা কভার দিয়ে মাত্র এক বাউন্সের জন্য হয় চার। শেষ বলে আবার ছক্কা হাঁকিয়ে সমীকরণটা ২৪ বলে ৪৫ রানে নামিয়ে আনেন কামিনস।
তবে এরপর আর সে অর্থে কিছু করতে পারেননি তিনি। বলা ভালো, তাকে করতে দেননি লুঙ্গি, শার্দুলরা। ইনিংসের ১৭তম ওভারে নিজের শেষ ওভার করতে এসে একটি উইকেটসহ মাত্র ৫ রান দেন লুঙ্গি। যেখানে ছিল একটি বাই ৪। নচেৎ ওভার থেকে মাত্র ১ রান পেত কলকাতা।
লুঙ্গির এমন ওভারের পরেও আশা ছাড়েননি কামিনস। শার্দুল করেন পরের ওভারটি। সেই ওভারের প্রথম বলে পূরণ করেন ব্যক্তিগত ফিফটি। মাত্র ২৩ বলে ৩ চার ও ৫ ছয়ে এ মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। ওভারের পঞ্চম বলে বাউন্ডারি ও শেষ বলে ১ রান নিয়ে স্ট্রাইক নিজের কাছেই রাখেন কামিনস।
শেষ দুই ওভারে ২৮ রান বাকি থাকে কলকাতার, উইকেট ছিল মাত্র ২টি। চেন্নাইয়ের সামনে বোলিং অপশন বলতে ছিলেন ৩ ওভারে ৫১ রান দেয়া কারান ও ৩ ওভারে ৪৭ রান দেয়া শার্দুল। এ দুজনের ওপরই ভরসা রাখেন ধোনি এবং কারানের হাতে তুলে দেন ১৯তম ওভার।
রাসেলের উইকেট নিয়ে চেন্নাইকে ম্যাচে ফেরানো কারান আরও একটি দুর্দান্ত ওভার উপহার দেন। ওভারের তৃতীয় বলে ভরুন চক্রবর্তীর রানআউট হলে আর মাত্র ১ উইকেট বাকি থাকে কলকাতার। এই ওভারে এক চারের মাত্র ৮ রানের বেশি নিতে পারেননি কামিনস।
ফলে শেষ ওভারে সমীকরণ দাঁড়ায় ৬ বলে ২০ রান, বল হাতে নেন শার্দুল ঠাকুর। তার করা লো ফুল টস ডেলিভারিটি লংঅফের দিকে হাঁকিয়েই পড়িমড়ি করে দুই রানের জন্য ছোটেন কামিনস। তিনি স্ট্রাইকিং প্রান্তে নিরাপদে পৌঁছলেও, অপরপ্রান্তে রানআউট হয়ে যান প্রাসিদ কৃষ্ণা।
যার ফলে শেষের পাঁচ বল আর খেলতে পারেননি কামিনস, ক্যারিয়ার সেরা টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ে ৪ চার ও ৬ ছয়ের মারে ৩৪ বলে ৬৬ রান করেও দলকে ১৮ রানে হারতে দেখেন তিনি। অন্যদিকে দুর্দান্ত এক জয়ের উল্লাসে মাতে পুরো চেন্নাই শিবির।
হলুদ আর্মিদের হয়ে বল হাতে ৪ ওভারে ২৯ রান খরচায় ৪ উইকেট নেন দ্বীপক চাহার। লুঙ্গি এনগিডি ৪ ওভারে খরচ করেন ২৮ রান, তার শিকার তিনটি উইকেট। তবে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন প্রথম ইনিংসে ৬০ বলে ৯৫ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলা ফাফ ডু প্লেসি।
নদী বন্দর / জিকে