প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণে প্রশাসনিক অভিযানের মধ্যেও পটুয়াখালীর দুমকিতে ইলিশ শিকারের মহোৎসব চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জনবল স্বল্পতা আর যানবাহন সংকটে দায়সারা অভিযান এড়িয়ে পায়রা, পাতাবুনিয়া ও লোহালিয়া নদীতে দিনে ও রাতে সমানতালে চলছে ইলিশ শিকার।
জানা যায়, উপজেলা প্রশাসন, মৎস্যবিভাগ, থানা-পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়হীনতার সুযোগে পরিবারের শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে জেলেরা দেদারছে শিকার করছেন মা ইলিশ। দুর্বল ডিজেল ইঞ্জিনের ট্রলারে উপজেলা প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান ফাঁকি দিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কৌশলী জেলেরা ইলিশ শিকার করেন।
অবরোধের দুই-তিন দিন পরই পায়রা, পাতাবুনিয়া ও লোহালিয়া নদীর তীরবর্তী জেলেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়েও তাদের ঠেকাতে পারছে না প্রশাসন। প্রশাসন অবশ্য অভিযোগটি মানতে নারাজ। তাদের দাবি, অভিযান মোটামুটি সফল হচ্ছে। মৎস্যবিভাগের নিয়মিত অভিযানে দুই-তিনটি নৌকা, ট্রলার ও কিছু ইলিশ জাল আটক হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, উপজেলার পাংগাশিয়া, আঙ্গারিয়া, লেবুখালী ও মুরাদিয়া ইউনিয়নবেষ্টিত পায়রা, পাতাবুনিয়া ও লোহালিয়া নদীর অন্তত ১১টি পয়েন্টে জেলেরা দিন ও রাতে সমানতালে ইলিশ শিকার করছে। কম সময়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ায় প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞার শুরু থেকেই (৭ অক্টোবর) নানান কৌশলের আশ্রয় নিয়ে নদীতে মা-ইলিশ শিকার করা হচ্ছে। মৎস্যবিভাগ ও প্রশাসনের বিশেষ অভিযানের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রেখেই ওই জেলেরা নৌকা ও জাল নিয়ে নদীতে ইলিশ শিকার করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জেলেরা তাদের পরিবারের শিশু-কিশোরদের হাতে নৌকা-জাল তুলে দিয়ে ইলিশ শিকার করছে। সূত্রমতে, অবরোধকালে প্রতিটি জেলেপল্লীতে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়। প্রতিটি জেলে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নৌকা-জাল নিয়ে নদীতে নামে আর নারী, শিশু-যুবা সবাই নির্ঘুম পাহারায় রাত কাটান নদীর তীরে।
দূর-দূরান্তে অভিযানের ট্রলার দেখলেই মোবাইল ফোনে স্ব-স্ব জেলেদের সতর্ক করে দেয় তারা। সংকেত পাওয়া মাত্রই দ্রুত নৌকা-জাল নিয়ে ঝোপঝাড়, পাতাবন ও ছোট ছোট নালা, খালে ঢুকে আত্মগোপন করে জেলেরা। অভিযানের ট্রলার ফাঁকা নদীতে মহড়া দিয়ে চলে গেলে ফের জাল ফেলে রাতভর ইলিশ শিকার জারি থাকে।
সূত্রটি আরও জানায়, চলতি মৌসুমে টনকে টন ইলিশ ধরা পড়লেও তা বাজারজাত হচ্ছে না। নির্দিষ্ট কয়েকজন পাইকার বিভিন্ন ঘাটে মাছগুলো কিনে গোপনে মজুদ করে রাখছে। অবরোধের পরে তা বাজারে তোলা হবে।
উপজেলার হাজিরহাট, লেবুখালী ফেরীঘাট, ভাঙ্গার মাথা, আঙারিয়া বন্দর, পাতাবুনিয়ার হাট, জেলেপাড়া, কদমতলা বাজার, উত্তর মুরাদিয়া ও জোয়ারগরবদিসহ অন্তত ১১টি মাছঘাট এলাকা সংলগ্ন পাইকারদের গোপনীয় আস্তানায় ককশেড ভর্তি করে ইলিশ মাছ মজুদ রাখা হচ্ছে। দিনের বেলায় কোথাও ইলিশের চিহ্নমাত্র দেখা না গেলেও প্রতিদিন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পর পরই নৌকা-জাল গুটিয়ে সারারাতের আহরিত ইলিশ বস্তায় ভর্তি করে জেলেরা যে যার মতো সটকে পড়ছে।
ইলিশ শিকার রোধ প্রশ্নে উষ্মা প্রকাশ করে আঙ্গারিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ গোলাম মর্তুজা বলেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে এ বছর ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আগের বছর এবং তারও আগের বছর ব্যাপক প্রচারাভিযান হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে জেলেদের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সভা করে ইলিশ রক্ষায় কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়। ওই সময় শতভাগ অভিযান সফল হয়েছে। কিন্ত এ বছর শুরুতে তেমন সভা-সেমিনার কিংবা প্রচারাভিযান চোখে পড়েনি।
তবে অভিযানের সপ্তাহখানেক পর দেরিতে হলেও উপজেলার মাসিক আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে এ বিষয়ে আলোচনাসাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ততক্ষণে প্রজনন মৌসুমের অর্ধেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, নিয়মিত অভিযানে ৭ অক্টোবর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ফারুক হাওলাদার নামের এক জেলেকে আটক ও দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকাসহ ১৫ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছে। উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম জনবল স্বল্পতা ও দ্রুতযান সংকটের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমরা আমাদের সীমিত শক্তি দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আল-ইমরান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নদীতে তেমন একটা নৌকা-জাল নেই। ইলিশ শিকার হচ্ছে না বলব না, তবে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা কলে শতভাগই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হব।
নদী বন্দর/এসএইচ