৫ আগস্ট ২০২৪। বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন প্রবল আন্দোলন ও হাজারো প্রাণের বিনিময়ে সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে লাখো ছাত্র-জনতা ঢুকে পড়েছিল গণভবন এবং জাতীয় সংসদ ভবনে। হিমালয়ের দেশ নেপালের কাঠমান্ডুর বর্তমান অবস্থা যেন ৫ আগস্টের সেই ঢাকার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদে কাঠমান্ডুতে ভয়াবহ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির পার্লামেন্টে ঢুকে পড়েছে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। পুলিশের গুলিতে প্রাণ গেছে ১৬ জনের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঠমান্ডুজুড়ে জারি হয়েছে কারফিউ, মোতায়েন হয়েছে সেনাবাহিনী।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিমালিয়ান’ জানাচ্ছে, সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকালে জেন জি প্রজন্মের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ মিছিল শুরু হলেও পরে বিক্ষোভকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে দেশটির সংসদে প্রবেশের চেষ্টা করে। এসময় তারা গাছের ডাল ও পানির বোতল ছুড়ে মারে, সঙ্গে দেয় সরকারবিরোধী স্লোগান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ জলকামান, টিয়ারগ্যাস এবং রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মাসে নেপালের মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেয়, দেশটিতে বিদ্যমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে সাত দিনের মধ্যে নিবন্ধন করতে হবে, যোগাযোগের জন্য প্রতিনিধি রাখতে হবে এবং অভিযোগ ও নিয়ম মানা বিষয়ক কর্মকর্তাও নিয়োগ দিতে হবে। এর জন্য ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
তবে অধিকাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানি সরকারের সেই নির্দেশ মানেনি। ফলে নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার পর গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে ফেসবুক, এক্স, হোয়াটসঅ্যাপসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যস, তাতেই তেতে ওঠে জেন জি প্রজন্ম। প্রতিবাদ জানাতে নেমে পড়ে কাঠমান্ডুর রাস্তায়।
বিক্ষোভের শুরু যেভাবে
এএফপির প্রতিবেদন বলছে, শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্তই এই বিক্ষোভের একক কারণ নয়, বহু তরুণ বিক্ষোভকারীর কাছে এই নিষেধাজ্ঞা ছিল সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জমে থাকা দীর্ঘ অসন্তোষের বিস্ফোরণ।
কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ‘হামি নেপাল’ নামে একটি সংগঠন সোমবার এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। এর জন্য অবশ্য তারা আগেই অনুমতি নেয়। সরকারের পদক্ষেপ ও দুর্নীতির প্রতিবাদেই এই কর্মসূচি এবং একই ধরনের আন্দোলন সারা দেশেই চলছে বলে জানান সংগঠনের চেয়ারম্যান সুধান গুরুং।
আয়োজকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিক্ষোভের রুট ও নিরাপত্তা নির্দেশনা জানান। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম পরে বই হাতে বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়।
দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট বলছে, নেপালে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ এবং ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী প্রায় ৩৬ লাখ। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য চালান। প্রথমে তারাই বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা-বিরোধী আন্দোলন থেকে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি নিবন্ধনবিহীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, জাতিকে দুর্বল করার যেকোনো চেষ্টা কখনোই সহ্য করা হবে না। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গুলি করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন একই নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। এমনকি আন্দোলন দমাতে ইন্টারনেটও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সারাদেশকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে সেই ফাঁকে গুলি করে মারা হয়েছিল হাজারো ছাত্র-জনতাকে।
কিন্তু তাতে আন্দোলন স্তমিত হওয়ার বদলে তা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রূপ নিয়েছিল। হাজারো ছাত্র-জনতা মেরেও ক্ষমতায় থাকতে পারেননি শেখ হাসিনা। পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট ভারতে পালাতে হয়েছিল তাকে। বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ দিয়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রীও কি একই পথে হাঁটছেন?
নদীবন্দর/জেএস