নয়ন যার সুন্দর তিনিই সুনেত্রা। সেই দিক থেকে নায়িকা সুনেত্রার নামকরণ ছিলো দারুণ ব্যঞ্জনাময়। এই অভিনেত্রীর ছিলো কাজল কালো ডাগর দুই চোখ। যে চোখের চাহনি পুরুষ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায় নিমিষেই।
ঢাকাই ছবির ইতিহাসে তার নাম থেকে যাবে সুপারহিট বহু ছবির নায়িকা হিসেবে। ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া দেলোয়ার ঝাহান ঝন্টু পরিচালিত ‘পালকী’ ছবিটি তাকে দিয়েছিলো অন্যরকম জনপ্রিয়তা। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত এক গ্রামীন নারীর হৃদয় বিদারক গল্পের ছবিটি ছুঁয়ে গিয়েছিলো আপামর দর্শকের হৃদয়। এখানে তাকে দেখা গিয়েছিলো গ্রামীন গল্পের নন্দিত নায়ক ফারুকের বিপরীতে। একাই ছিলেন মা ও মেয়ের দ্বৈত চরিত্রে।
তার সময়ে তিনি ছিলেন সেরা আবেদনময়ী নায়িকাদের একজন। গলার স্বরেও ছিলো একটা অচেনা আবেদন, যা মনকে দোলা দিতে পারে খুব সহজেই। সেই সুনেত্র, সুকণ্ঠী দীর্ঘদিন বাজিমাত করেছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে। ফারুক, সোহেল রানা, আলমগীর, ওয়াসিম, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, জাফর ইকবাল, নাদিম (পাকিস্তান), মান্নাদের বিপরীতে অভিনয় করে উপহার দিয়েছেন অনেক হিট সিনেমা।
অনেকদিন হয়ে গেল তার কোনো দেখা নেই। নেই কোনো সংবাদেও। চলচ্চিত্রের মানুষেরাও জানেন না কোথায় আছেন, কেমন আছেন তিনি। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতিতেও পাওয়া গেলা না নব্বই দশক মাতিয়ে রাখা চিত্রনায়িকা সুনেত্রাকে নিয়ে নিখুঁত কোনো তথ্য। কেউ কেউ ভাসা ভাসা তথ্যে বললেন, সুনেত্রা বর্তমানে রয়েছেন পাকিস্তানে। সেখানে সংসার পেতেছেন এক মঞ্চ অভিনেতার সঙ্গে। কেউ বললেন তিনি নাকি বাংলাদেশেই রয়েছেন। থাকেন সাভারে।
আবার শিল্পী সমিতির একটি সূত্র বলছে, একসময় পাকিস্তানে থাকলেও বর্তমানে বাবার ভিটা ভারতের কলকাতাতেই রয়েছেন তিনি। অভিনয়ের সঙ্গে আর সম্পৃক্ত নন।
জানা যায়, নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে ঢাকাই ছবি থেকে আড়ালে চলে যান সুনেত্রা। কিন্তু কেন তিনি চলচ্চিত্র ত্যাগ করেছিলেন সেই তথ্য পাওয়া গেল না কোথাও। জানা গেছে, বাংলাদেশে এসে প্রথমদিকে প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্র পরিচালক বেবি ইসলামের স্ত্রী তন্দ্রা ইসলামের বাড়িতে থাকতেন। পরে তিনি নিজেই নিজের আবাসন ব্যবস্থা করেছিলেন।
জাফর ইকবালের বিপরীতে ‘ঘর ভাঙা ঘর’ ছবিটিকেই সুনেত্রা অভিনীত সর্বশেষ বাংলাদেশি ছবি বলে ধরা হয়। এটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৯২ সালে। এরপর কিছুদিন কাজ করেন কলকাতার ছবিতে। ১৯৯৯ সালের সেখানে সর্বশেষ সুনেত্রা অভিনীত ‘দানব’ ছবিটি মুক্তি পায়। সেই ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন কলকাতার শক্তিমান অভিনেতা ভিক্টর ব্যানার্জির বিপরীতে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পেলেও সুনেত্রা ছিলেন কলকাতার মেয়ে। সেখানেই মঞ্চে অভিনয় করতেন। তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন গুণী নির্মাতা মমতাজ মালী। ১৯৮৫ সালে মুুক্তি পাওয়া ‘উসিলা’ ছবি দিয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে অভিষিক্ত হন তিনি। শুরুতেই নায়ক হিসেবে পান তৎকালীন সুপারস্টার অকাল প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবালকে। এরপর তিনি অভিনয় করেছেন ‘বোনের মতো বোন’, ‘ভাবীর সংসার’, ‘সাধনা’, ‘রাজা মিস্ত্রি’, ‘যোগাযোগ’, ‘সুখের স্বপ্ন’, ‘আলাল দুলাল’, ‘শুকতারা’, ‘সহধর্মিনী’, ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘বন্ধু আমার’, ‘শিমুল পারুল’, ‘ভাই আমার ভাই’, ‘লায়লা আমার লায়লা’, ‘দু:খিনি মা’, ‘বিধান’, ‘নাচে নাগিন’, ‘ভুল বিচার’, ‘সর্পরানি’, ‘বিক্রম’, ‘বাদশা ভাই’, ‘রাজা জনি’, ‘আমার সংসার’ ইত্যাদি হিট ছবিগুলোতে।
কলকাতায় তিনি কাজ করেছেন ‘সিঁথির সিঁধুর’, ‘মনসা কন্যা’ ইত্যাদি ছবিগুলোতে। তিনি ‘তালাশ’, ‘শূন্যে কি তালাশ’ নামের দুটি উর্দু ছবিতেও অভিনয় করেছেন। পাকিস্তানের টিভি নাটকেও সুনেত্রা ছড়িয়েছেন অভিনয়ের দ্যুতি।
১৯৭০ সালের ৭ জুলাই সুনেত্রা জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে। পারিবারিক নাম তার রিনা সুনেত্রা কুমার। দুই ভাইবোনের মধ্যে সুনেত্রা ছোট। তিনি মাধ্যমিক শেষ করেছিলেন কলকাতার গখলে মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাণিবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতি চর্চার প্রতি মনযোগী ছিলেন তিনি। নাচ, গান ও অভিনয়ে নিজেকে তৈরি করেছিলেন।
নদী বন্দর / জিকে