ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন ধরে অস্বস্তির কারণ হয়ে থেকেছে যে বিষয়টি, সেটি নিঃসন্দেহে ফারাক্কা বাঁধ। ভারতে এটির পোশাকি নাম ‘ফারাক্কা ব্যারাজ প্রজেক্ট’, এবং বহু আলোচনা ও বিতর্ক পেরিয়ে চলতি বছরের এই মে মাসে প্রকল্পটি পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করছে।
বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান অভিযোগ ছিল এই ফারাক্কার ফলেই প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে গেছে। অন্য দিকে ভারত বরাবর যুক্তি দিয়ে এসেছে কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার জন্য ফারাক্কা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না!
ফারাক্কা চালু হওয়ার দু’দশকেরও বেশি সময় পর ১৯৯৬তে ভারত ও বাংলাদেশ যে ঐতিহাসিক গঙ্গা জলচুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে অবশ্য ভাগীরথী ও পদ্মায় গঙ্গার জল ভাগাভাগি নিয়ে একটা ফর্মুলায় দুই দেশ একমত হতে পেরেছিল।
তিরিশ বছর মেয়াদি সেই চুক্তির কার্যকালও প্রায় শেষের পথে, চুক্তির নবায়ন নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে ফারাক্কা নিয়ে বিতর্ক, বিরোধ বা দোষারোপের পালা কিন্তু কখনওই থামেনি।
তবে ফারাক্কার জন্যই পদ্মার দু’কূলে মানুষের জীবন-জীবিকা আজ বিপন্ন বলে যেমন বাংলাদেশের অভিযোগ – তেমনি ভারতেও কিন্তু ফারাক্কার সমালোচনা কম নয়।
যেমন মাত্র কয়েক বছর আগেই ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে দেওয়ারও দাবি তুলেছিল বিহার সরকার, যে রাজ্যটির অভিযোগ প্রতি বছর ফারাক্কার কারণেই তাদের বন্যায় ভুবতে হয়। ফারাক্কার উজানে ও ভাঁটিতে গঙ্গার ভাঙনও ওই এলাকার মানুষের জন্য খুব বড় সমস্যা।
তা ছাড়া অনেক বিশেষজ্ঞই মানেন কলকাতা বন্দরকেও সেভাবে বাঁচাতে পারেনি ফারাক্কা – যে কারণে উপকূলের কাছে তৈরি করতে হয়েছিল আর একটি স্যাটেলাইট বন্দর হলদিয়া।
তাহলে আজ ৫০ বছর পরে এসে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারত ঠিক কী ভাবছে? পাশাপাশি, ফারাক্কা প্রকল্পটাতেই বা তখন ঠিক কী করা হয়েছিল এবং সেগুলো কী ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে?
ফারাক্কা ব্যারাজ প্রোজেক্ট বা এফবিপি-র সার্ধশর্তবর্ষপূর্তিতে সরেজমিনে ফারাক্কা ও আশেপাশের এলাকায় এবং কলকাতা বন্দরে গিয়ে ঠিক এই বিষয়গুলোতেই নজর দিয়েছে বিবিসি বাংলা – এই প্রতিবেদনে থাকছে তারই সারাংশ।
ফারাক্কা প্রকল্পটা আসলে ঠিক কী?
এক কথায় বলতে গেলে, ফারাক্কা হলো গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে ও কৃত্রিম খাল কেটে পদ্মার দিক থেকে জলের প্রবাহ ভাগীরথীর দিকে সরিয়ে আনা – যাতে কলকাতা বন্দরকে বাঁচিয়ে রাখা যায়!
প্রকল্পের বর্তমান প্রধান, টেকনোক্র্যাট আর ডি দেশপান্ডের বলতে কোনো দ্বিধা নেই, ‘যে লক্ষ্য সামনে রেখে ফারাক্কা তৈরি করা হয়েছিল, আমরা জোর গলায় বলতে পারি সেটা পুরোপুরি সফল হয়েছে। কলকাতা বন্দর যে আজও টিঁকে আছে, তা ফারাক্কার জন্যই!’
আসলে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে নির্মিত এই প্রকল্পটির মূল লক্ষ্যই ছিল গঙ্গার প্রবাহ থেকে অতিরিক্ত জল ভাগীরথীতে সরিয়ে আনা ও তার মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানো – যার জন্য কাটা হয়েছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার লম্বা একটি ‘লিঙ্ক ক্যানাল’ বা কৃত্রিম খাল।
ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পর সুন্দর সাজানো গোছানো টাউনশিপে নিজের বাতানুকূল অফিসঘরে বসে আর ডি দেশপান্ডে বিবিসিকে বলছিলেন, পদ্মা নয়, গঙ্গার মূল প্রবাহ আগে ভাগীরথী দিয়েই যেত – ফারাক্কা শুধু সেই ‘পুরনো ইতিহাস’কেই কিছুটা ফিরিয়ে এনেছে।
তিনি জানাচ্ছেন, ‘গঙ্গোত্রী থেকে উৎপন্ন হয়েছে যে পবিত্র গঙ্গা নদী, সাতশো বছর আগেও তার পুরো প্রবাহটা কিন্তু এখনকার ভাগীরথী-হুগলী দিয়েই যেত আর মোহনায় তা সাগরদ্বীপের কাছে গিয়ে মিশত – ওটাই গঙ্গার আসল মোহনা ছিল বলে সেই তীর্থের নাম হয়েছিল গঙ্গাসাগর।’
‘তখন পদ্মা ছিল গঙ্গার একটা ছোট শাখানদী। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে সেই প্রবাহ পদ্মার দিকে সরতে থাকে।’
‘ফলে ব্রিটিশ আমলে যখন দেখা গেল তাদের জাহাজ কলকাতা বন্দরে ন্যূনতম ড্রাফটও পাচ্ছে না, তখন ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার আর্থার কটন গঙ্গা থেকে সম্ভাব্য দুটো জায়গায় – রাজমহল বা ফারাক্কায় – খাল কেটে ভাগীরথীতে জল টানার প্রস্তাব দেন।’
ফারাক্কা থেকে খাল কাটলে দৈর্ঘ্য অনেক কম হবে বলে অবশেষে ফারাক্কাকেই এই কাজের জন্য বেছে নেওয়া হয়।
স্বাধীন ভারতে ১৯৬১ সালে অবশেষে সেই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, আর ১৯৭৫ সালে এসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেন ফারাক্কা ব্যারাজ।
প্রকল্পের কাজ অবশ্য তারও বছরকয়েক আগেই প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ফারাক্কার কমিশনিং পিছিয়ে দিয়েছিল বলে অনেকেই মানেন।
ফারাক্কার কাজ যখন শুরু হয়, তখন গঙ্গার ভাঁটিতে ছিল ‘শত্রু দেশ’ পূর্ব পাকিস্তান – কিন্তু রাতারাতি সেখানে একটি ‘বন্ধু দেশ’ চলে আসার ফলে ফারাক্কায় একতরফাভাবে গঙ্গা থেকে জল প্রত্যাহার ভারতের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছিল।
যদিও অবশেষে ১৯৭৫-এর গোড়ায় এসে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে সক্ষম হন – ঠিক হয় এপ্রিল-মে মাসে প্রতি দশদিন অন্তর গঙ্গা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ জল সরানো হবে। সেই ‘পরীক্ষা’ অবশ্য পরেও আরও বহু বছর ধরে চলতে থাকে।
সে বছরের মে মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কার উদ্বোধন করেন দেশের সেচমন্ত্রী জগজীবন রাম, পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে যা কয়েক কোটি কিউসেক বাড়তি জল কলকাতায় এনে ফেলেছে!
ভূতাত্ত্বিক ও নদী গবেষক ড. পার্থসারথি চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘কলকাতা বন্দরে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত কিন্তু আমাদের নাব্যতা (নেভিগেবিলিটি) ছিল, ২৬ ফুট ড্রাফট ছিল। এবং তাতে ২৯১ দিন এই বন্দরে জাহাজ ঢুকত, মানে ওই ২৬ ফুট ড্রাফটের জাহাজ ঢুকত। ১৯৬০ সালের পর থেকে কিন্তু মারাত্মক অবস্থা হয়।’
‘এখন এই ফারাক্কা অঞ্চল কেন? ফারাক্কা অঞ্চলকে ব্যারাজ করার জন্য বাছা হলো, তার কারণ সেখানে একশো বছরের মধ্যে নদী নড়াচড়া করেনি, তার ব্যাঙ্কের মধ্যেই ছিল। এবং ওই ব্যারাজটা ওইখানে করলে, জলটা, ব্যারাজটার ঠিকমতো স্টেবিলিটি থাকবে।’
তিনি আরও জানাচ্ছেন, ফারাক্কায় এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যাতে কলকাতায় সম্পূর্ণ ‘সিল্ট-ফ্রি’ বা পলিমুক্ত জল সরবরাহ করা যায়।
ড. পার্থসারথি চক্রবর্তী বলেন, তার জন্য ওখানে ‘ছাঁকনি’ দেওয়া আছে, যে কারণে ফারাক্কার জল কলকাতায় পানীয় জল হিসেবেও সাপ্লাই দেওয়া হয়।
ফলে ১০০০ মাইলেরও বেশি পথ পেরিয়ে উত্তর ভারতের ‘লাইফলাইন’ গঙ্গা ফারাক্কাতে এসে ব্যারাজের বাধায় বাঁধা পড়েছে – আর সেখানে মোট ১০৯টি লকগেটেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নদীর জলের প্রবাহ।
আর ফারাক্কাতে নদীর ডান দিক থেকে কাটা হয়েছে ৩৮.৩ কিলোমিটার লম্বা ভাগীরথী ফিডার ক্যানাল, যা জঙ্গীপুরের কাছে ভাগীরথীতে গিয়ে মিশেছে এবং পরে সেই নদী হুগলী নামে পরিচিতি পেয়েছে।
এককালের ছোট্ট গ্রাম ফারাক্কাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একটি আধুনিক উপনগরী, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণপ্রান্তের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগও স্থাপন করেছে ব্যারাজের ওপর দিয়ে তৈরি ট্রেনলাইন ও রাস্তা।
ক্যানালের জলে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে, এমন কী ইলিশও! ভারতে হলদিয়া থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ‘১ নম্বর জাতীয় জলপথে’রও অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই ক্যানাল।
আশির দশকে ফারাক্কাতে এনটিপিসি-র যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, তারাও ব্যবহার করে এই ক্যানালের জল। ভাঁটির দিকে মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, তারাও এই জলের ওপর নির্ভরশীল।
সব মিলিয়ে ফারাক্কা শুধুমাত্র একটি বাঁধ ও খালই নয়, এই প্রকল্পকে ঘিরে গত পঞ্চাশ বছরে একটা বিরাট ক্যানভাসই আঁকা হয়ে গেছে বলা চলে – যাকে বিশেষজ্ঞরা ‘ফারাক্কা ইকোসিস্টেম’ নামে বর্ণনা করে থাকেন।
ফারাক্কা নিয়ে ভারতেও এতো বিতর্ক কেন?
ফারাক্কার প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে ভারতেও অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দিহান ছিলেন। তবে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর যুক্তিটা এতটাই প্রবল ছিল যে সেই সব আপত্তি বিশেষ ধোপে টেঁকেনি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলী, কপিল ভট্টাচার্য তো ফারাক্কার বিরোধিতা করে সরকারি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন।
ফারাক্কা প্রকল্প কেন বিপজ্জনক, তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি অনেক লেখালেখিও করেছেন। পরবর্তী জীবনে কপিল ভট্টাচার্য অ্যাক্টিভিস্টে পরিণত হন, যুক্ত ছিলেন মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সঙ্গেও।
১৯৮৯ সালে মি ভট্টাচার্যের মৃত্যুর ২৭ বছর পর, ২০১৬ সালে বিহারের রাজ্য সরকার ফারাক্কা বাঁধ ‘তুলে দেওয়ার জন্য’ কেন্দ্রের কাছে আনুষ্ঠানিক দাবি জানায়।
তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে যুক্তি দিয়েছিলেন, ফারাক্কার জন্যই তার রাজ্য প্রতি বছর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে – অতএব বাঁধটাই তুলে দেওয়া হোক!
নীতীশ কুমার তখন প্রকাশ্যেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘গঙ্গায় খুব বেশি পলি পড়ছে বলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
‘আর যখন থেকে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি হয়েছে তখন থেকেই এই অবস্থা। নইলে আগে নদীর প্রবাহের সঙ্গে অনেকটা পলি বঙ্গোপসাগরে চলে যেত, সমুদ্রে গিয়ে মিশত।’
দশ-বারো বছর ধরে ফারাক্কার ‘প্যাটার্ন’ স্টাডি করেই এ মন্তব্য করছেন, তখন এ কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
নীতীশ কুমার আজও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, তবে যে কোনো কারণেই হোক ফারাক্কা বিরোধিতার সুর তিনি অনেক স্তিমিত করে ফেলেছেন। এই মুহূর্তে তিনি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক সঙ্গীও।
তবে ফারাক্কার উজানে ঝাড়খন্ড-বিহারের সীমান্ত এলাকায় গিয়েও দেখেছি, সেখানে আমজনতারও এই বাঁধকে নিয়ে বিস্তর অভিযোগ – বর্ষাতে যেমন, তেমনি শুকনা মৌসুমেও!
বিহারের আহমদাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ওয়াহিদ শেখের কথায়, ‘বর্ষার সময় ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়া উচিত, নইলে বিহারবাসীর খুব দুর্দশা! অথচ বর্ষার সময়ই গেট বন্ধ রাখে, নদী ওভারফ্লো করলে তখনই গিয়ে গেট খোলে – যখন বিহার ডুবে গেছে! বর্ষার মৌসুম এলেই যদি গেট খুলে দেয়, তাহলে বিহার একটু স্বস্তি পাবে!’
ঝাড়খন্ডের সাহেবগঞ্জ জেলায়, গঙ্গাতীরের লাধোপাড়া গ্রামের মিশির শেখ আবার বলছিলেন, রাজমহলের ওপারে গঙ্গা যদি দেখেন – গরমে নদী তো একদম শুকিয়ে যায়!
‘ছোট একটা নালার মতো গঙ্গা বইতে থাকে, বাকি পুরোটা শুকিয়ে যায়। এখন সব জল (বাংলাদেশে) ছেড়ে দিলে কোনো ফসলই হবে না, কিষাণ তো না খেয়ে মরবে!’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায় ফারাক্কা অঞ্চলে বাঁধের প্রভাব নিয়ে ফিল্ড স্টাডি ও গবেষণা করেছেন – এ ব্যাপারে তারও মিশ্র অভিজ্ঞতা।
‘ফারাক্কায় নদীর বুকেও চর পড়েছে, মাঝনদীতে বক দাঁড়িয়ে আছে এটাও যেমন দেখেছি – তেমনি গঙ্গার বিধ্বংসী ভাঙনে পারের মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যেতেও দেখেছি’, বলছিলেন তিনি।
সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, এই নদীর যে প্যাটার্নের চেঞ্জটা, ইটসেল্ফ নদীটার মধ্যে, তার দুই পারে সবটারই ওপরে একটা ইমপ্যাক্ট ফেলেছে ফারাক্কা ব্যারাজ। ডেফিনিটলি। তার পজিটিভগুলো আমরা পেয়েছি, নেগেটিভগুলোও আমরা দেখতে পাচ্ছি।
ফারাক্কাতে তার শেষ ফিল্ড স্টাডিতে স্থানীয় গ্রামবাসীরা ফারাক্কা বাঁধকে তুলনা করেছিলেন একটা সাপের মাথা চেপে ধরার সঙ্গে!
‘এমনিভাবে দেখাল যে, একটা সাপ রয়েছে তার মুখটা আপনি চেপে ধরলেন – মানে মাথাটা, তাহলে সে তো দেখবেন ছটফট করছে বেরোনোর জন্য।’
‘অ্যাজ ইফ ব্যারাজটা যেন একটা সাপের মুখটা চেপে ধরার মতো জিনিস – এবং নদী তখন, নদীর কোর্সটা তো পাল্টাচ্ছে – সে আর একভাবে যেতে পারছে না, সে যেহেতু রেস্ট্রিক্টেড, বাউন্ডেড … তাই সে আরও বেশি করে … প্যাটার্নটা, কার্ভসগুলো আরও বেশি হচ্ছে, ছটফট করার মতো … ওরা সুন্দর একটা এক্সপ্ল্যানেশন দিয়েছিল’, জানাচ্ছেন তিনি।
ফারাক্কার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আবার জানাচ্ছেন, নদীর ভাঙন ঠেকাতে না-পারলে ফারাক্কা অচিরেই তাদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনবে!
ফারাক্কা আসনের এমএলএ (বিধায়ক) মনিরুল ইসলাম বিবিসিকে বলছিলেন, ফারাক্কার জন্য আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাটা অবশ্যই ভালো হয়েছে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মেলবন্ধন এটা তৈরি করেছে ঠিক, কিন্তু আমাদের আপিল কি গঙ্গার ড্রেজিং-টা করে দিলে আমরা কিন্তু বিপদমুক্ত হব আর কী!
‘এই ড্রেজিং না করলে আগামী পঞ্চাশ বছর বলছেন কেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা নদীর গর্ভে চলে যাব। তো আমাদের কাছে ব্যারাজ একরকম অভিশাপের কারণ হয়েও দাঁড়িয়ে গেছে আর কী!’
তিনি আরও বলছিলেন, মুর্শিদাবাদের মোরগ্রাম থেকে নিয়ে আপনার মালদা পর্যন্ত আমাদের এই ভৌগোলিক অবস্থানটা দেখবেন – আমরা একটা সরু রাস্তার ওপর বাস করছি। ওদিকে ঝাড়খন্ড, এদিকে নদী, বাংলাদেশ – এইটুকুনটা!
‘তাই আমাদের হাজার হাজার একর যে নদীর গর্ভে গিয়েছে, মাঝনদীটাকে যদি ড্রেজিং করে পাথর দিয়ে বেঁধে দেয় আর কী, তাহলে অনেক লোক ওখানে চাষবাস করে, বাড়িঘর করে থাকতে পারবে’, কেন্দ্রের কাছে দাবি জানান তিনি।
তবে ফারাক্কা নিয়ে এরকম অনেক বিতর্ক থাকলেও বাঁধ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে কাজ কিন্তু বিশেষ এগোয়নি!
ফারাক্কা বাঁধ ‘ডিকমিশন’ করতে নীতিশ কুমার প্রস্তাব দেওয়ার পর দেশের জলসম্পদ মন্ত্রণালয় কিন্তু একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করেছিল – যাতে কেন্দ্রের তরফে পাঁচজন আর বিহার সরকারের তরফে পাঁচজন সদস্য ছিলেন।
সেই কমিটিতে বিহারের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন দেশের সুপরিচিত নদী বিশেষজ্ঞ ও গবেষক হিমাংশু ঠক্কর।
হিমাংশু ঠক্কর বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল ফারাক্কা বিহারের ওপর ঠিক কী প্রভাব ফেলেছে, তা নিরূপণ করা’
‘কিন্তু ফারাক্কা হওয়ার আগে ও পরে নদীতে ড্রেইনেজ কনজেসশন কী, বন্যার তীব্রতা ও কত ঘন ঘন বন্যা হয়েছে, নদীর ধারণক্ষমতা কত, সে সব ব্যাপারে সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন আমাদের কোনো তথ্য-উপাত্তই দেয়নি, ফলে আমরাও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।’
তবে ফারাক্কার ‘বিরূপ প্রভাব’ যে গোটা এলাকায় পড়েছে তাতে হিমাংশু ঠক্করের কোনো সন্দেহ নেই, নীতিশ কুমারের প্রস্তাবেও যথেষ্ঠ যুক্তি ছিল বলে তিনি মনে করেন।
আগামী পঞ্চাশ বছরে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ কী?
ফারাক্কা থেকে টানা ফিডার ক্যানালে শুষ্ক মৌসুমে কতটা জল টানা যাবে, আর মূল নদী দিয়ে পদ্মায় কতটা জল ছাড়া হবে – ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তির মূল কথা কিন্তু সেটাই।
এখনকার চুক্তি বলছে, প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে – এই শুকনা মৌসুমের সময়টায় প্রথম দশদিন ক্যানাল আর পরের দশদিন করে পদ্মা অন্তত ৩৫০০০ কিউসেক পরিমাণ জল পাবেই (‘অ্যাশিওর্ড অ্যামাউন্ট’ বা প্রতিশ্রুত পরিমাণ)।
এই জলের প্রবাহ ঠিকঠাক যাচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য ব্যারাজ থেকে কয়েকশো মিটার দূরে ভাঁটির দিকে মনিটরিং স্টেশন-ও আছে, যেখানে ভারত ও বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা একসঙ্গে সার্বক্ষণিক অবস্থান করেন।
ঠিক একই ধরনের যৌথ মনিটরিং স্টেশন আছে বাংলাদেশের দিকে পদ্মার ওপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছেও।
এখন আগামী বছর (২০২৬) কোনো শর্তে সেই গঙ্গা চুক্তির নবায়ন হয় – বা আদৌ হয় কি না – যথারীতি তার ওপরও অনেকটা নির্ভর করছে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ।
এদিকে উজানের বিহারে কিংবা ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানিকচক-ধুলিয়ানে ফারাক্কাকে নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, খোদ ফারাক্কা এলাকার গ্রামবাসীরা কিন্তু প্রকল্পের কারণে খুশি – তারা চান বাঁধের দীর্ঘায়ু।
ফারাক্কা উপনগরী লাগোয়া পলাশিগ্রামের বাসিন্দা তপন মিশ্র যেমন বলছিলেন, ‘অনেক কিছু থেকে সুবিধা হয়েছে। যেমন কৃষকরা জল পাচ্ছে, জেলেরা মাছ ধরে দুটো খেতে পাচ্ছে।’
‘এই বাঁধ হওয়াতে এখানে শহর তৈরি হয়েছে মোটামুটি ছোটমোট একটা, কেউ বিজনেস করে খাচ্ছে, কেউ চাকরি করে খাচ্ছে … দূর দূর ঝাড়খন্ড-ফাড়খন্ড কোথায় বন্যা হচ্ছে ওটা তো ধরলে চলবে না! ভালো হয়েছে, খারাপ হয়নি!’
ফারাক্কা ব্রিজ হওয়ায় স্থানীয় মৎস্যজীবী খগেন প্রামাণিকের আবার খুব সুবিধা হয়েছে দূরদূরান্তে মাছের চালান পাঠাতে।
তিনি পাশ থেকে যোগ করেন, এই গঙ্গায় যে ব্রিজটা হওয়া, ব্রিজটা হওয়াতে কি উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দারুণ যোগাযোগ হয়ে গেছে – এইটা মেইন মেরুদন্ড হয়ে গেছে উত্তরবঙ্গের জন্য!
‘আগে এখানে সকালে নৌকাতে চাপলে দুপুর, বৈকালে গিয়ে পৌঁছাত ওপারে – সেই জিনিসটা এখন আর নেই!’
ফারাক্কার ‘হিউম্যান জিওগ্রাফি’ নিয়ে কাজ করেছেন যে গবেষকরা, তারা অবশ্য নিশ্চিত নন সাধারণ লোকের ভাবনা প্রকল্পে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে।
সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, ‘আমার রেজিলিয়েন্স বিল্ডিংয়ের মধ্যে যদি আমি মানুষের মতামত, তাদের চোখে দেখা বা তাদের এক্সপেরিয়েন্স – কীভাবে তারা দেখছে নদীটাকে, সেটা যদি আমরা না ধরতে পারি, তাহলে কিন্তু একটা গ্যাপ রয়ে গেল।’
‘আর যেটা আপনি বলছেন যে পঞ্চাশ বছর পরে কী হবে, এই গ্যাপটা কিন্তু আগাগোড়া রয়েই গেছে। আমরা কিন্তু কখনও দেখছি না এই রেজিলিয়েন্স বিল্ডিংয়ের মধ্যে মানুষকে ইনভলভ করা হচ্ছে বা কমিউনিটিগুলোকে ইনভলভ করা হচ্ছে।’
তিনি আরও মনে করেন, ফারাক্কাকে ঘিরে যে প্রযুক্তিগত সমাধানগুলো ভাবা হয়েছে – কত বছর তার মেয়াদ, বা তার পরে কী হবে – এগুলো নিয়ে একটা অস্পষ্টতা আছেই, আর সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সঙ্গে প্রোজেক্টের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
‘কারণ এটা একটা শক্তিশালী নদী, সেটাও তো আমাদের মেনে নিতে হবে যে তার একটা ন্যাচারাল প্রসেস বা স্বাভাবিক গতি ও ছন্দ আছে! সেটা গ্রামের মানুষ যেভাবে বুঝছে আমরা বুঝছি না’, বলছিলেন সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আবার এই প্রেক্ষাপটেই কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন, বাঁধটা কিন্তু বর্তমান আকারে আর না রাখলেও চলে!
হিমাংশু ঠক্কর বিবিসিকে বলছিলেন, আমেরিকা, ইউরোপ ও সারা দুনিয়া জুড়ে অজস্র বাঁধের ডিকমিশনিং হচ্ছে – শুধু আমেরিকাতেই গত ৩০ বছরে ২০০০রও বেশি ড্যাম ডিকমিশন করা হয়েছে, ইউরোপেও হয়েছে শত শত।
‘তবে এটাও ঠিক, গঙ্গার মতো বিশাল একটা নদীতে কোনো ড্যাম ডিকমিশন করার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিন্তু তেমন নেই। তবে তার পরেও কাজটা খুবই সম্ভব – আর নানাভাবেই এই ডিকমিশনিং করা যায়।’
এখানে তিনি প্রস্তাব দিচ্ছেন ‘অপারেশনাল ডিকমিশনিং’-এর, অর্থাৎ ব্যারাজের ওপরে ট্রান্সপোর্ট লিঙ্কটা রেখে গেটগুলো সব খুলে রাখার বা তুলে দেওয়ার, যাতে রেল ও সড়ক সংযোগ রেখেও নদীকে স্বাভাবিকভাবে বইতে দেওয়া যায়।
‘পাশাপাশি ক্যানালটা এখন যে সুবিধাগুলো দিচ্ছে, সেটা কীভাবে বজায় রাখা যায় তাও দেখতে হবে। এতে কী হবে, ড্যামের মূল কাঠামোটা অক্ষত রেখেও ফারাক্কার অপারেশনাল ডিকমিশনিং করা যাবে’, বলছিলেন হিমাংশু ঠক্কর।
আবার এর একদম উল্টো মতবাদটা হল – কলকাতার স্বার্থেই ফারাক্কাকে যেভাবে হোক বর্তমান আকারেই রক্ষা করতে হবে!
এই মতে বিশ্বাসী ড. পার্থসারথি চক্রবর্তীর কথায়, কলকাতা নদীবন্দরকে বাঁচাতেই হবে। কারণ কলকাতা নদীবন্দর শুধু কলকাতা কলকাতা বললে হবে না, সমগ্র পূর্ব ভারত এবং নর্থ-ইস্টার্ন রিজিওন – তার একটাই পোর্ট ভারতবর্ষের বলতে গেলে, আমাদের কলকাতা বন্দর। সেখানে কোনও কম্প্রোমাইজ নেই।
‘এর জন্য ফারাক্কা ব্যারাজটাকে যেভাবে হোক রেনোভেট করতে হবে, ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রাকচার কীভাবে রেনোভেট করবে সেটা পুরোপুরি প্রকৌশলীদের ওপর।’
‘আমার নদীটা তো আছে, নদীর খাত আছে … আর আপনারা যেটা ভাবেন নদীর পার ভাঙছে, সব নদীরই পার ভাঙে! আমি নদীর ধারে থাকবো কেন? নদীর ধারে একটা বাফার থাকবে তো, সেই বাফার জোনটা দিয়ে রাখতে হবে’, যুক্তি দিচ্ছেন তিনি।
এটা ঠিকই, পৃথিবীতে কোনো নদীবাঁধের আয়ুই অনন্তকাল নয় – কখনও তিরিশ, কখনও চল্লিশ বা কখনও আশি বছর পর একটি ব্যারাজ ডিকমিশনিং করা বা তুলে দেওয়ার বহু নজির নানা দেশে আছে।
ফারাক্কার ক্ষেত্রে ঠিক কী করা হবে আর কখন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের – কিন্তু সেই লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বলে এখনও কোনো প্রমাণ নেই।
ফারাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এই প্রকল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণই নেই।
ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পের মহাপরিচালক আর ডি দেশপান্ডে বিবিসিকে বলছিলেন, ‘দেখুন, এটা তো শুধু একটা ডাইভারশান বা জল টানার প্রকল্প, এখানে কিন্তু তেমন স্টোরেজ বা জলাধার কিছু নেই।’
‘স্টোরেজ প্রকল্পগুলোর আয়ু হয়তো একশো বছর হয়, কারণ পলি পড়ে তার ধারণক্ষমতা পূর্ণ হয়ে যায়। ফারাক্কায় সে সমস্যা নেই, ফলে এটা অনায়াসে একশো বছরেরও বেশি টিঁকতে পারে।’
তবে তিনি স্বীকার করেন ফিডার ক্যানালের বেড (খাত) আর দু’পারের ক্ষয় ও ভাঙন একটা বড় সমস্যা, যেটা হয়তো ‘ক্রস রেগুলেটরে’র মতো কিছু বসিয়ে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হবে।
‘কিন্তু ফারাক্কা বাঁচবেই, বাঁচাতেই হবে – কারণ কলকাতা শহর, কলকাতা বন্দর আর গত পঞ্চাশ বছরে নদীকে ঘিরে যে ইকোসিস্টেম তৈরি হয়ে গেছে তাকে রক্ষা করতে হলে ফারাক্কাই একমাত্র ভরসা’, খুব আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গীতে বলেন প্রকল্পের প্রধান।
ফলে ফারাক্কা নিয়ে আগামী দিনে কী করা উচিত, সে সম্বন্ধে ভারতেও নানা ধরনের মতামত আছে।
ফারাক্কার ভবিষ্যত ঠিক কোন পথে, তা এখনও কারও জানা নেই, কিন্তু এটা বলা যায়, ফারাক্কাকে নিয়ে বিতর্ক বোধহয় পরের ৫০ বছর ধরেও চলবে!
সূত্র: বিবিসি বাংলা
নদীবন্দর/এসএইচবি